ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৫ উপজেলাজুড়ে দেশের বৃহত্তম হাওর

সজিব তৌহিদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৫
৫ উপজেলাজুড়ে দেশের বৃহত্তম হাওর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দেশের বৃহত্তম হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত। এর নাম হাকালুকি হাওর।

এটি এশিয়ার অন্যতম সেরা মিঠাপানির জলাভূমি। সংস্কৃত শব্দ 'সাগর' থেকে 'হাওর' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কালক্রমে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এভাবে সাগর-সায়র-হাওর।

কথিত আছে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক রাজা ও তার রাজত্ব মাটির নিচে সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে সেই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকালুকি’। তা পরবর্তীতে নাম ধারণ করে হয় ‘হাকালুকি’।

এছাড়া প্রচলিত তথ্যমতে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি একসময় বাস করতেন কুকি ও নাগা উপজাতিরা। তাদের নিজস্ব উপজাতীয় ভাষায় এ হাওরের নামকরণ করা হয় ‘হাকালুকি’। যার অর্থ 'লুকানো সম্পদ।

হাকালুকিতে কতো লুকানো সম্পদ আছে সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এখানে যে নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর মূল্যবান মৎস্য সম্পদ রয়েছে তা কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়। সিলেট বিভাগ মূলত হাওর অঞ্চল হিসেবে খ্যাত। এ অঞ্চলে রাজনগর, দিরাই, পাখনা, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ছোট-বড় বেশ কিছু হাওর-বাঁওড় রয়েছে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়া এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার- এ পাঁচ উপজেলার ১ হাজার ১শ’ ১৫ হেক্টর জমিতে হাকালুকি হাওরের বিস্তৃতি।

হাওরে বিল আছে প্রায় ২৪০টি। প্রায় সারা বছর কিছু কিছু বিলে পানি থাকে। হাকালুকি হাওরের জলরাশির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে জুড়ি ও পানাই নদী। বছরে ছয়মাস পানির নিচে তলিয়ে থাকে। আর বাকি ছয়মাস হাওরের জমি চাষাবাদে ব্যস্ত সময় কাটান হাওর উপকূলবাসী।

বর্ষা মৌসুমে হাকালুকি রূপালি জলে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত পানি আর পানিই শুধু চোখে পড়ে। সেই পানিতে ঝকঝকে সূর্য ও চাঁদের প্রতিচ্ছবি এক অপূর্ব মায়াময় দৃশ্য তৈরি করে।

ভোর, বিকেল এবং সূর্যাস্তের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য হাকালুকির বিভিন্ন পর্যটন স্পটে মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। আর শীতকালে জলাভূমি কমে গিয়ে দূর্বাদলে ঢাকা ধু-ধু মাঠ দেখে মনের ভেতর অচেনা এক শূন্যতা অনুভূত হয়। এ যেন সীমানাহীন সবুজ মাঠে মাঠে একাকার হয়ে যাওয়া মধ্যখানে উঁকি দেয় নাম না জানা কোনো জলরাশি। কোথাও আবার চোখে পড়বে গরুর পাল।

এই হাওরে গলদা চিংড়ি, বাঘমাছ, চিতল, পাবদা, কালবাউশ, রানী, রাঁচি, বাতাসি, কোকিলাসহ প্রায় ৭০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ টন মাছ আহরণ করা হয় হাকালুকি হাওর থেকে। হাওর এলাকার প্রায় ১১টি ইউনিয়নের আড়াই শতাধিক গ্রামের চার লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন।

হাওরে আড়ং, বরুণ, করচ, হিজল ও মাখনাসহ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। মূলত জলাবদ্ধতা সহনশীল উদ্ভিদই দেখা যায় হাওরে।

এখানে শীত মৌসুমে প্রায় ৪৮ প্রজাতির লক্ষাধিক অতিথি পাখির আগমন ঘটে। অতিথি পাখির মধ্যে পান ভুলানি, কাস্তেচড়া, পানকৌড়ি, বেগুনি কালিম, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, রাজসরালি,  মেটেমাথা টিটি, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, বালিহাঁস, ভূতিহাঁস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া আছে ১২ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী এবং ৬৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। শুষ্ক মৌসুমে হাওরটি গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। হাওর উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকজন খরা মৌসুমে তাদের গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি কয়েক মাসের জন্য হাওরে বসবাসরত এক শ্রেণির মানুষের কাছে পাঠিয়ে দেন।

তারা গবাদিপশু দেখাশোনার বিনিময়ে দুধ সংগ্রহ করে বিক্রির মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। বর্ষা মৌসুম চলে এলে গবাদিপশুর মালিকরা তা ফিরিয়ে নেন। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'বাথান'। বাথান প্রক্রিয়ার কারণেই এ অঞ্চল দুধ ও দইয়ের জন্য বিখ্যাত।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে বাসস্থান নির্মাণ, অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগে হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

এছাড়া স্বার্থান্বেষী মহলের কর্মকাণ্ডে হাকালুকি হাওরের অস্তিত্ব, সম্পদ, উদ্ভিদ, জীববৈচিত্র্য এবং সৌন্দর্য প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি হাওর রক্ষায় সবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ০০২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৫
টিআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।