পঞ্চগড় থেকে ফিরে: পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। হিমালয়ের সন্নিকটে পঞ্চগড় জেলার সমতলে চোখ জুড়ানো চা বাগান পেরিয়ে বাংলাবান্ধা।
সড়কটি এশিয়ান হাইওয়ের আওতায়। এরপর তেতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা সড়কের প্রায় তিন কিলোমিটার পথজুড়ে পাথরের রাজ্য।
এ তিন কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে গেলে ধুলোর কবলে পড়তে হবে। চারিদিকে শুধু পাথর আর পাথর। পাথর ভাঙা ধুলোতে মরুভূমির ন্যায় সড়কটি। দেখে মনে হবে, পাথরের রাজ্য। ভারত থেকে আমদানি করা বড় বড় পাথর ট্রাকের মাধ্যমে এখানে আনা হচ্ছে। এরপর সেই পাথর ভেঙে ব্যবহার উপযোগী করছেন হাজারও শ্রমিক। তাদের দেখে চেনার উপায় নেই। ধুলো-বালি মেখে সবার চেহারা এক।
সরজমিনে দেখা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা বড় আকারের পাথর টুকরো ট্রাক থেকে নামানো হয়। এরপর সেগুলো মেশিন দিয়ে কয়েকটি সাইজ অনুযায়ী কাটতে হয়। ছোট ছোট টুকরো করা পাথর এরপর ট্রাকে করে আনা হয় বাংলাবান্ধায়।
অনেক শ্রমিক একদিন কাজ করে পরের দিন বাসায় বসে থাকেন। প্রচুর ধুলোবালির কারণে অনেকে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে অাক্রান্ত। পাথর ভাঙার কারণে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা দেখলে মনে হবে ধুলোঝড়ের কবলে পড়া একটি জনপদ।
তেতুলিয়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। প্রায় সাত বছর পাথর ভাঙার কাজ করছেন। শ্বাসকষ্টের সঙ্গে শরীরের ব্যথাও রয়েছে।
রফিকুল বাংলানিউজকে বলেন, কোমরে ব্যথা করে ব্যাটা! ধুলায় নাক বন্ধ হয়। তবে ধুলা আর কোমরের ব্যথার ভয় করলে তো পেট চলবে না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের সেবক, চেন লেম, বালাসন নদী ও মাটিগাড়া থেকে পাথর আসে এখানে। ভারত থেকে প্রতি টন পাথর কিনতে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬শ টাকা। এসব বড় বড় পাথর ৩/৪, ৫/৮ ও আধা ইঞ্চি সাইজ করে ভাঙা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে ভাঙা পাথর ৯৫ টাকা সেফটি দরে বিক্রি করা হয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোরলেনসহ নানা ধরনের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহার করা হয় এসব পাথর। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানিও এসব পাথর ব্যবহার করে। এক কথায়, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পাথর সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যায়। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয়ে বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি চলে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত।
কিন্তু শ্রমিকরা কাজ করেন প্রায় ১২ ঘণ্টা। এখানে দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন, দিন হাজিরা ও চুক্তিবদ্ধ। দিন হাজিরায় আড়াই থেকে ৩শ টাকা আয় হয় শ্রমিকদের। তবে নারী শ্রমিকদের ভাগ্যে দুই থেকে আড়াইশ টাকার বেশি জোটে না। অন্যদিকে, চুক্তিবদ্ধভাবে কাজ করা শ্রমিকরা প্রতিদিন ৬শ থেকে ৭শ টাকা আয় করতে পারেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভারত থেকে পাথর, গম, ভুট্টা ও বাইসাইকেল আমদানি করা হয়। অন্যদিকে, ভারত ও নেপালে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট, ব্যাটারি, কোমল পানীয়, সাবান, বিস্কুট, চানাচুর, জুস, কাঁচসহ বিভিন্ন দ্রব্য রফতানি হচ্ছে। এছাড়া নেপাল থেকে চিকন দানা মশুরডাল আমদানি করা হয়।
বাংলাবান্ধা অ্যান্ড কাস্টমস স্টেশনে দায়িত্বরত সিপাহী প্রমোদ রায় বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২৫টি বাংলাদেশি ট্রাক ভারতে প্রবেশ করে। অন্যদিকে, ২শ থেকে ২শ ২০টি ভারতের ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে যার অধিকাংশই পাথরবোঝাই।
ভারত থেকে ১৫শ টাকা টন হিসেবে পাথর কেনা হয় আর বাংলাদেশে প্রতি সেফটি পাথর বিক্রি করা হয় ৯৫ টাকা দরে। এক টন পাথর ভেঙে ব্যবহার উপযোগী করে অনেক সময় দুই হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
এখানে শ্রমিক থেকে শুরু করে পাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ফড়িয়া, মহাজন ও ট্রাক চালকের সংখ্যা অগণিত। প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার মানুষের জীবিকা পাথরের মাধ্যমে।
ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জের শাহজাহান। নিজের ভিটামাটিও ছিলো না। ১০ বছর আগে চলে আসেন তেতুলিয়ায়। স্বপরিবারে বেছে নেন পাথর ভাঙার কাজ। এখন পথের পাশে এক টুকরো জমি কেনাসহ খেয়ে পরে বেঁচে রয়েছেন। শাহজাহানের মতো তেতুলিয়ার হাজারও মানুষের জীবিকা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম পাথর ভাঙার কাজ।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
এমআইএস/এসএস