খুলনা (দাকোপ) থেকে ফিরে: পট পট পট, ফুটছে চাল... হচ্ছে মুড়ি। খুলনার দাকোপে পারচালনা গ্রামের ছত্তার বিশ্বাসের বাড়িতে চলছে মুড়ি ভাজার ধুম।
মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত ছিলেন হাওয়া বিবি। বাংলানিউজের ক্যামেরায় ধরা পড়ে সেই মুড়ি ভাজার পুরো প্রক্রিয়া।
কাজে নেই এক দণ্ডের বিরাম। নেই সামান্য অসতর্কতা। কারণ, মুড়ি ভাজার প্রক্রিয়াটি সময় কাটার সঙ্গে হাতের কাজের সুচারু সমন্বয়ের বিষয়। এখানে সামান্য হেরফেরে মুড়ি হয় পুড়ে যাবে, নয়তো থেকে যাবে চাল।
হাওয়া বিবি জানালেন, প্রতিদিন তার একার পক্ষে এক মণ চালের মুড়ি ভাজা সম্ভব। এক খোলা মুড়ি ভেজে শেষ করতে সময় লাগে ১০ মিনিটের মতো। দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করলে মোট ৬০ খোলা মুড়ি ভাজতে পারেন। এভাবে প্রায় ৪০ কেজি চালের মুড়ি ভাজা সম্ভব।
হাওয়া বিবি অবশ্য এ বাড়িতে কামলা দিচ্ছেন। দিনের মজুরি ১শ’ ২৫ টাকা। তবে দিনের হিসেবে নয়, এক মণ চালের মুড়ি ভেজে দিলে ওই পরিমাণ অর্থ মেলে। সঙ্গে তিনবেলা খাবার পাওয়া যায়। তার ছেলেটিও আশেপাশেই থাকে। তারও খাবার এ বাড়িতে- জানান হাওয়া বিবি।
ছত্তার বিশ্বাসের গৃহস্থবাড়িতে খাবার নিয়ে কারও কোনো ভাবনা নেই। তাই নিশ্চিন্তে সারাদিন দক্ষ হাতে মুড়ি ভাজেন হাওয়া বিবি। একেক খোলায় প্রতিটি মুড়ি ফুটিয়ে তোলাই যেনো তার পণ।
হাওয়া বিবি জানান, একেক খোলায় আধা কেজির বেশি চাল তোলা যায়। প্রথমে চাল ভাজা হয় পাঁচ থেকে ছয় মিনিট। এ সময় খুব দক্ষ হাতে নারকেল পাতার শলা বেঁধে তৈরি ‘কুচি’ (নাড়ানি) দিয়ে চাল নাড়তে হয়। চালে প্রয়োজনীয় পরিমাণ লবণ পানি মিশিয়ে সারাক্ষণ নাড়তে হয়, যেন চালটি ফুটে না যায়।
পাশের চুলোয় একটি হাঁড়ির ভেতর গরম হতে থাকে বালু। দুই দিকে সমান জ্বাল নিশ্চিত করতে হয়। পরে চালগুলো যখন লালচে রঙ ধারণ করে, ততোক্ষণে বালুও পর্যাপ্ত গরম হয়ে ওঠে। এরপর চালগুলো ঢেলে দিতে হয় বালুর হাঁড়িতে। সাঁড়াশির মতো একটি আঙটা দিয়ে দুই দিক থেকে আটকে ধরে বালুর হাড়িটি চুলো থেকে তুলে এনে দক্ষতার সঙ্গে ঢুলিয়ে ঢুলিয়ে ঘোরাতে হয়। এ সময় পটপট শব্দে ফুটতে থাকে চাল আর তৈরি হয় মুড়ি। সবগুলো চাল ফুটে মুড়ি হয়ে গেলে তা বালুসহ ঢেলে দিতে হয় ঝাঁঝরের ওপর। তাতে ঝাঁকুনি দিলে বালু চলে যায় নিচে পেতে রাখা পাত্রে। আর ঝাঁঝর ভরতে থাকে টাটকা মচমচে মুড়িতে। এটিই পুরো প্রক্রিয়া।
মুড়ি সাদা রাখতে ইউরিয়া ব্যবহারের কথা অনেকেরই জানা। কিন্তু হাওয়া বিবির মুড়ি সাদা হয় দেশীয় পদ্ধতিতে। সেজন্য লবণ পানির সঙ্গে মিশিয়ে দেন লাউয়ের সাদা ফুল। তাতেই মুড়িতে সাদা রঙ ধরে। আর চালের মুড়ি দক্ষ হাতে ভাজতে পারলে তা লালচে হওয়ার আগেই নামানো সম্ভব।
এভাবেই তৈরি হচ্ছে মুড়ি। পারচালনা গ্রামে তৈরি হয়ে তা যাবে শহরে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের খুলনা নগরীতে অনেক অভিজাত, বড় অফিসের কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদের বাড়িতে বাড়িতে যাবে এই মুড়ি।
ছত্তার বিশ্বাসের ওপর সেরা মুড়ি নিয়ে বিশ্বাস সবার। আর সে আস্থার পূর্ণ মূল্য দিয়ে সামান্য ভেজাল ছাড়া, সম্পূর্ণ অরগ্যানিক উপাদান ও দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি হয় মুড়ি। মোটা চালের মোটা মুড়ি। খেতে সুস্বাদু, মচমচে।
** এ ‘মণিহার’ আমায় নাহি সাজে!
** ধানের ফলনে কৃষকের হাসি, দামে বেজার
** শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন: যশোরের যশ, খেজুরের রস
** শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন: ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
** সুন্দরবন এক্সপ্রেস থেকে: আউশের চিড়া ও তার কারিগরের গল্প
বাংলাদেশ সময়: ০৭১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৫
এমএমকে/এসএস/এএসআর