ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ক্লিওপেট্রা আর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট ও জাফরানের গল্প

স্বাস্থ্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৬
ক্লিওপেট্রা আর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট ও জাফরানের গল্প

ঢাকা: রূপের রানী ক্লিওপেট্রা তার ত্বকের লাবণ্য বাড়াতে গোসলের সময় এই ভেষজটি শরীরে মাখাতেন। যুদ্ধে আহত হলে দ্রুত সুস্থতার জন্য ক্ষতস্থানে লাগাতেন গ্রিক সম্রাট আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট।



শরীরের সৌষ্ঠব বাড়ানো, রূপ-ত্বকের লাবণ্য বাড়ানো এবং নানা রোগের মহৌষধ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এ ভেষজের নাম জাফরান। ইংরেজিতে স্যাফরন বলে পরিচিত এ সপুষ্পক উদ্ভিদ একাধারে মশলা এবং প্রসাধনী। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্রকাস স্যাটিভাস।

কেবল সৌষ্ঠব বা রূপ-ত্বকের আবেদন বাড়ানো নয়, জাফরান বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস; মশলাটি খাবার-দাবারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের (এমন উপাদান যা কোষের ক্ষতিকর জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ক্ষতিকর যৌগগুলোকে ভেঙে ফেলে, ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রাখে শরীরকে সুরক্ষিত) ভূমিকায় থাকে। কাজ করে ক্যান্সার, স্মৃতিশক্তি বিলোপ হওয়ার রোগ বা আলজেইমার, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং বিষণ্নতার বিরুদ্ধেও। মাংস, কাবাব, ভাত, মিষ্টির সুঘ্রাণ ও স্বাদ বাড়াতেও এর জুড়ি নেই।

এমন উপকারী এই মশলা-প্রসাধনীর মূল্যও আকাশচুম্বী। বিশ্বের ৮০ ভাগ জাফরান উৎপাদক ইরানে পণ্যটি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২০ ‍হাজার  ইউরো (বাংলাদেশি ১৭ লাখ টাকারও বেশি) দরে। এতো দামি বলে জাফরানকে ‘ইরানের লাল সোনা’ বলেও মনে করে স্থানীয়রা।

অথচ এই উপকারী-অর্থকরী জাফরান উৎপাদনে প্রায় ভাটা পড়ে যাচ্ছিল। কেন? কারণ এটি শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ।
 
প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে আড়াইশ’ টন জাফরান উৎপাদন হয়। এরমধ্যে কেবল ইরানেই উৎপাদন হয় ৮০ ভাগ। এখানে বীজ বপনের কয়েক সপ্তাহ পর প্রতি শরতে সপুষ্পক গাছটির ফুল ফোটে। এরপর চাষীরা ফুল কেটে সেগুলোকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শুকোতে দেন। ওই শুকোনো জাফরানের ফুল থেকেই প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় খাবারের মশলা বা গায়ে মাখানোর মূল্যবান প্রসাধনী। এক কেজি জাফরান পেতে দেড় লাখেরও বেশি ফুল লাগে।

উৎপাদনে শ্রম ও সময়সাধ্য অন্য অনেক বস্তুও রয়েছে। তাহলে কেবল জাফরান উৎপাদনেই কেন ভাটা পড়বে? গত সেপ্টেম্বরে স্পেনে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে জাফরান বিশেষজ্ঞরা এ প্রশ্ন তুলেছেন।

সম্মেলনে জাফরান বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব লিস্টারের অধ্যাপক জিএস হেসলোপ-হ্যারিসন বলেন, ভেজাল জাফরানের ছড়াছড়িতে মানুষ আসল জাফরানের স্বাদ ও উপকারিতা বুঝতে পারছে না। উপরন্তু ভেজাল জাফরান স্বাস্থ্যেরও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। বিধায় মানুষ জাফরান সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু ভাবছে। ভোক্তার নেতিবাচক মনোভাব দারুণভাবে অনুৎসাহিত করছে জাফরান উৎপাদনকে।

তাহলে করণীয়? সে নিয়েও সম্মেলনে ভাবনার কথা তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বাজারে থাকা জাফরানের স্বাদ ও উপকারিতা পরীক্ষা করলেই আসল জাফরানের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। নিশ্চিত হওয়া যাবে ভেজাল জাফরানের উৎপাদন কেন্দ্রও।

সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা চাইছেন জাফরান উৎপাদনে ‘পুনর্বিপ্লব’ ঘটাতে। সে লক্ষ্যে একটি আন্দোলনের রোডম্যাপও এসেছে সম্মেলনে। জাফরান-অর্থনীতি গড়ে তুলতে তারা ‘স্যাফরোনোমিকস’ (স্যাফরন+ইকোনমিকস) নামে আন্দোলনের একটি প্লাটফর্ম গঠন করেছেন। এই স্যাফরোনোমিকস আপাতত তিনটি লক্ষ্য-জাফরান উৎপাদন ও বাজারজাত বাড়ানো, ভেজাল ও কৃত্রিম জাফরান বাজারজাত প্রতিহত এবং এর উৎপত্তিস্থল ও বিশুদ্ধতার বিষয়ে নিশ্চিত করা-নিয়ে কাজ করবে।

স্পেনে যখন বিশেষজ্ঞরা জাফরানের পুনর্বিপ্লবে এমন আন্দোলনের কথা ভাবছিলেন, তখন ‘দমকা হাওয়া’ বয়ে যাচ্ছে সদ্য পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞামুক্ত ইরানের বাজারে। ইউরোপের ক্রেতারা তাদের বাজারে ভিড় করায় ইরানিরা জাফরান বিক্রিতে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে নিতে থাকে। আর এই দর চড়চড় করে বাড়তে থাকায় নতুন করে ভাবনা জাগতে থাকে ইরানের উৎপাদক চাষীদের মনেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের চাষীদের ইতিবাচক মনোভাব আর একসময়ের অন্যতম শীর্ষ জাফরান রফতানিকারক স্পেনের আগ্রহকেও কাজে লাগাতে হবে ‘পুনর্জাগরণে’। একসময় স্পেন শীর্ষ উৎপাদক থাকলেও পরে ইরান থেকে নিয়ে এসে এটি ফের ‘স্প্যানিশ’ জাফরান বলে রফতানি বাজারে ছাড়তে থাকে। বিষয়টি বুঝতে পেরে দেশটির জাফরান রফতানি বন্ধ করে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বিশেষজ্ঞদের আরও আশাবাদী হওয়ার কারণ, কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানও জাফরান উ‍ৎপাদন করছে। দেশটির কৃষকদের আফিমের পরিবর্তে জাফরান উৎপাদনে উৎসাহিত করে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। উপকার-লাভ বিবেচনায় জাফরান উৎপাদনে ছোট-খাট বিপ্লবের সুর আসছে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ম্যাসিডোনিয়া, কসভো এবং অস্ট্রিয়ার মতো দেশগুলো থেকেও।

জাফরানপ্রেমীদের আশাবাদী হতে আলো জ্বালছে প্যারিসের জ্য থিয়েরসেলিনের পরিবারও। ১৮০৯ সাল থেকে বংশ পরম্পরায় জাফরান উৎপাদন, প্যাকেটজাত ও বাজারজাত করার ব্যবসা করে আসছে পরিবারটি। মারাইস জেলা শহরে থিয়েরসেলিনদের দোকানে এক গ্রাম ওজনের ইরানি জাফরান ছোট বোতলে করে বিক্রি হয় ১৩ দশমিক ৯০ ইউরোতে।

২০০৮ সালে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে ৩ সন্ত্রাসী থিয়েরসেলিনের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে ‘লাল সোনা’ জাফরান লুট করে নিয়ে যেতে চায়। হামলায় থিয়েরসেলিনের স্ত্রী আহত হলেও নিরাপদেই থেকে যায় তাদের ‘জীবিকার অবলম্বন’ জাফরান।

থিয়েরসেলিন বলেন, ‘কোকেনের চেয়েও অনেক বেশি মূল্যবান জাফরান। এতো স্বাস্থ্যকর ও লাভজনক হওয়ার পরও আমরা এ নিয়ে কেন উৎসাহিত হবো না!’

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৬
এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।