ময়মনসিংহ : আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই হাকিমের। পঁয়ত্রিশের কোটায় বয়স।
তার দোকানে ইট দিয়ে বানানো অস্থায়ী চূলোয় আগুন জ্বলছে। সস্তায় বিকোনো পেঁয়াজু ও পাপড় ভাজা হচ্ছে। সীমিত আয়ের মানুষরাই এ দোকানের ক্রেতা। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি। ফলত দম ফেলার ফুরসত নেই হাকিমের।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদ্রাসার মসজিদের উদ্যোগে বার্ষিক ধর্মীয় সভাকে ঘিরে হাকিমের মতো সড়কের পাশে রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন আরো জনা বিশেক ভ্রাম্যমাণ দোকানি।
মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১ টায় গিয়ে দেখা গেলো এমন দৃশ্য। ঝালমুড়ি, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, চটপটি, ফুচকাসহ হরেক রকমের দোকান চোখে পড়লো।
স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী হাকিমের এ ভ্রাম্যমাণ দোকানে ক্রেতারা এসেই গরম গরম পাপড় আর পিঁয়াজুর অর্ডার দিচ্ছেন। এ ধর্মসভা শেষ হলেই হাকিম দোকান গুটিয়ে বাড়ি ফিরবেন। ক্রেতাদের গমগমে অবস্থা জানান দিলো তার বেচা-বিক্রি বেশ।
৫০ গ্রাম পিঁয়াজু ৫ টাকা আর দু’সাইজের প্রতি পিস পাপড় ৩ ও ৫ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি। ভেজাল তেলে ভাজা হচ্ছে এ দু আইটেমের মুখরোচক খাবার। অবশ্য হাকিম নিজেও এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে জানেন না। এদিকটায় খেয়াল নেই ক্রেতাদেরও।
কী তেলে পিঁয়াজু-পাপড় ভাজছেন, এমন প্রশ্ন করতেই একগাল হাসি দিলেন এ দোকানি। ‘সয়াবিন তেলের দাম বেশি। আর পামওয়েল দামে সস্তা। এই তেল তো খারাপ না। খারাপ হইলে তো কাস্টমাররা খাইতো না। ’
তেল-ডালসহ সব মিলিয়ে ১ হাজার ৫শ’ টাকার মতোন খরচা হয়েছে হাকিমের। বলেন, ‘বেচাবিক্রি ভালই হইতাছে। ৫ থেকে ৬শ’ টাকার মতোন লাভ থাকবো। ’
হাকিমের পাশেই একই খাবার ভেজে চলেছিলেন তার ভাতিজা মিলন (২০)। চাচা-ভাতিজা মিলে শীতের সময়টাতে বিভিন্ন ধর্মসভা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এভাবেই ডালের বড়া, পাপড় বিক্রি করেন।
আর বাকী সময় খামারে শ্রম বিকোন। তাদের বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার জোরবাড়িয়া গ্রামে।
প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। আর গ্রাম-গঞ্জে সন্ধ্যার পর পরই শীত-কুয়াশা একাকার। অন্যান্য দিনে হাকিমের মতো ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ীরা বাড়ি ফিরলেও কোথাও ধর্মসভা বা অনুষ্ঠান হলে সেখানকার প্রবেশ পথের পাশেই দোকান খুলে বসেন। এটাকে অনেকটাই ‘রথ দেখা, কলা বেঁচা’ বলেও মন্তব্য করেন ভাতিজা মিলন।
ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া সড়কের কাতলাসেন বাজার এলাকার ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়ে বসে যাওয়াদের একজন হযরত আলী। তার বাড়ি স্থানীয় দেওখোলা গ্রামে। জীবন সায়াহ্নেও হাল ধরে রাখতে হয়েছে অশীতিপর এ বৃদ্ধের। একে একে তিনি পার করেছেন ৫৫ বছর। এখনো ৫ সদস্যের ভারী সংসার চালাতে গলদঘর্ম হতে হয় তাকে।
প্রতিদিন বাড়ির কাছের স্থানীয় দেওখোলা বাজারে তিলের তক্তি, বাদামের তক্তি, বুট, বাদাম ও খুরমাসহ বিভিন্ন শুকনো খাবারের ব্যবসা করেন। মঙ্গলবার রাতেও এসব আইটেম নিয়ে হাজির হয়েছেন এখানে।
‘মচমচা তক্তি খেতে ভারী মজা’ বলছিলেন এ দোকানের ক্রেতা আশরাফ নামে একজন। আর কেরোসিন তেলের কুপি বাতি জ্বালানো দোকানে ব্যবসা হচ্ছে কেমন, এমন প্রশ্নের উত্তরে হযরত আলী বলেন, ‘দুই পয়সা বেশি কামাইয়ের আশাতেই দোকান দিছিলাম। অহন খালি হাতে ফিরতে হইবো না। চাল-ডাল কিইন্ন্যাই বাড়ি যাইবার পামু। ’
একটু এগুতেই দেখা গেলো, ডালের বড়া বিক্রি করছেন হীরা মিয়া (৪০)। মাটির উপর বিছানো চটের বস্তায় আয়েশ করে বসে টাকা গুণছেন। চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ।
খাবারের এসব দোকানের পাশাপাশি শীতবস্ত্রের দোকানও দিয়ে বসেছেন অনেক ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। কিন্তু প্রত্যাশা মাফিক বেচা-কেনা না হওয়ায় দোকান গুটিয়ে নিতে দেখা গেলো ময়মনসিংহ শহর থেকে আসা আলামিনকে। বয়স ৩০ বছর। ‘ভাবছিলাম, ওয়াজ মাহফিলও হুনমু, ব্যবসাও করমু। কিন্তু কাস্টমার নাই। ব্যবসা লাটে উঠছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৬
জেডএম/