ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

পারিল নওয়াধার মিলনমেলা

স্মরণঅলিন্দে নিসর্গপ্রেমী নওয়াজেশ আহমদ

মাহমুদ হাফিজ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০১৬
স্মরণঅলিন্দে নিসর্গপ্রেমী নওয়াজেশ আহমদ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জনকণ্ঠ পত্রিকা যখন তুঙ্গে, সেই মধ্যনব্বুইয়ে সাংবাদিক তোয়াব খানের অ্যাসাইনমেন্টে মানিকগঞ্জের দুর্গমগ্রাম পারিল নওয়াধায় গিয়েছিলাম বড় কষ্ট করে। যে গ্রামের নাম পারিল নওয়াধা- উচ্চারণেও দাঁত ভাঙে, এতো জায়গা থাকতে সেখানে কেন পাঠালেন তোয়াব ভাই আগে বুঝিনি।



পৌঁছেই ভুল ভাঙে। দেখি, দেশের প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যক, সাংবাদিক, শিল্পী, আলোকচিত্রী, কার্টুনিস্ট, লোকশিল্পী দিব্যি উপস্থিত। শীতের পিঠা-পায়েসের স্বাদের সঙ্গে বৃক্ষ-পাখপাখালি ভরা ছায়া সুনিবিড় গ্রাম উপভোগ করে তারা পুলকিত, আনন্দে মাতোয়ারা। নগরজীবন থেকে দূরে অজপাড়াগাঁয়ে দেশ-জগৎখ্যাত গুণীদের অনায়াসে জড়ো করে আনন্দ-আয়োজনে মাতিয়েছেন, এর পেছনের যাদুকরটি কে?

এমন কৌত‍ূহলের মধ্যেই জানতে বাকি থাকে না শান্ত, সৌম্য, বিনয়ী ব্যক্তিত্বের এক ‘বয়সী তরুণ’ এসবের কেন্দ্রে। তার নামেই আলোকিত এ গ্রাম- তিনি ড. নওয়াজেশ আহমদ। বৃক্ষসখা, পুষ্পসখা, নিসর্গপ্রেমী কিংবা খ্যাতিমান আলোকচিত্রী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যার নামডাক বিস্তৃত।

এরপর থেকে শীতকালে বহুবছর পারিল নওয়াধায় যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বহুবছর বাদে শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) এ গ্রামে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকের মিলনমেলায় উপস্থিত হয়ে অনেকটা নষ্টালজিক হয়ে পড়েছি।

কালজয়ী গুণী ড. নওয়াজেশ আহমদের মৃত্যুর পর ফিবছর এর আয়োজন করে যাচ্ছেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পী নাসিম আহমদ নাদভী। আজও এখানে অনেককেই দেখতে পাচ্ছি। আজকের মিলনমেলায় হাজির হয়েছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ড. শামসুজ্জামান খান, ড. এনামুল হক, শিল্পী কালিদাস কর্মকার, সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, আইয়ুব ভুঁইয়া, ক্যামেরা ব্যক্তিত্ব গোলাম মোস্তফা, অভিনেতা মামুনুর রশিদ, শংকর শাঁওজাল, শিল্পী কনক চাঁপা চাকমা, নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু, গীতিকার আ বা ম ছালাউদ্দিন, প্রবাসী সাংবাদিক নাজমুন নেসা পিয়ারী, সংবাদপাঠক রেহানা পারভীন, শিল্পী নাসরিন বেগম, কবি পিয়াস মজিদসহ নতুন প্রজন্মের বহু গুণী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী, স্থপতি ও আলোকচিত্রী।
আনুষ্ঠানিকতা বলতে শীতের খেজুর রস, পিঠা-পায়েস, মুড়ি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন আর রোদে পিঠ দিয়ে আড্ডা। অনেকে পারিবারিক জাদুঘরটি ঘুরছেন, কেউ পারিবারিক কবরস্থানে দোয়া মোনাজাত করে পরিবারের মরহুমদের আত্মার মাগফিরাত ও কল্যাণ কামনা করছেন।

অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বলেন, বন্ধু নওয়াজেশ এ বাড়িতে আসার জন্য বহুবার বলেছেন। আজ এখানে এসে সবাই আনন্দ আয়োজনে ব্যস্ত। তার জন্য আমার মন দুঃখে উদ্বেলিত। আজ যদি নওয়াজেশ থাকতেন, তাহলে এই মিলনমেলা আমার জন্য আনন্দের কারণ হতো।

কালিদাস কর্মকার বললেন, ভালো লাগছে। শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের এ মিলনমেলার ধারাটি চমৎকার। অনুষ্ঠান আয়োজক ড. নওয়াজেশের ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পী নাসিম আহমেদ নাদভী বলেন, আমার দাদা খান বাহাদুর নজিবউদ্দিন আহমদ এ এলাকার চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। চাচা ড. নওয়াজেশ বিশ শতকের শুরু থেকে এ মিলনমেলার চলটি করেন। সেই ধারা আমরা অব্যাহত রেখেছি।

নওয়াজেশ আহমেদ জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। এটাও জানি না, কতোবড় মাপের হলে এ জাতি মানুষকে মূল্যায়ন করবে! তবে এটুকু বলতে পারি, সাহিত্যভাবুক, সৃজনশীল আলোকচিত্রী, বৃক্ষ ও নিসর্গপ্রেমী যে কোনো অভিধায় চিত্রিত করলেই নওয়াজেশ আহমদের মাপটা অনেক উচ্চে। যে ব্যক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নেন, এনালগ ক্যামেরার মতো একটি সাধারণ যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে আজীবন নিয়োজিত করেন নিজেকে, সাহিত্য-শিল্পকে তুলে চিত্রবিম্বিত করে নতুন সৃজন উন্মাদনায় মত্ত হন, তার মাপ কতোটা উচ্চে তা বলাই বাহুল্য। ঃ

যুক্তরাষ্ট্রের পিএইচডি ডিগ্রির সময় জাতিসংঘ কৃষিসংস্থায় চাকরির জীবন বাদ দিলে নওয়াজেশ আহমদের জীবন নিবেদিত বাংলাদেশের ফুলপাখি, নদী আর বৃক্ষে। বাংলাদেশের বন-বাদাড়ে অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা ফুল যা আমাদের জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ, এ সম্পর্কে জানতে গেলে নওয়াজেশ আহমদের ছবি বর্ণনার দ্বারস্থ হতে হবে। ভেরেন্ডা, মটমটিয়া, মাকড়িশাল, রক্তকুঁচ, শাল, শিমুল, হিজল, হরিতকিসহ নাম জানা অসংখ্য ফুলের ছবি তুলেছেন বাংলার আনাচে কানাচে ঘুরে। বাংলার বনফুল নামে ইংরেজি ও বাংলায় তার অ্যালবাম রয়েছে। এছাড়া তার অসংখ্য আলোকচিত্রের অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ, পোর্ট্রেট অব বাংলাদেশ, বার্মা, কোয়েস্ট অব রিয়েলিটি, ফ্লাওয়ার্স অব বাংলাদেশ, ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে, গৌতম ইত্যাদি।

নওয়াজেশ আহমদই একমাত্র সৃজনশীল যিনি আলোকচিত্রকে জীবনের সংশ্লেষ ঘটাতে কাজ করেছেন। এর সঙ্গে দিয়েছেন শিল্প-সাহিত্যের মিশেল। ক্যামেরায় নিছক ছবি তোলার কাজটি করেই ক্ষান্ত হননি, এর সঙ্গে মানবজীবনের নিবিড় যোগসূত্রটি রচনা করে তাকে আলাদা মাত্রায় উন্নীত করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের নিসর্গ ও জীবনের অকৃত্রিম বর্ণনা প্রাণিত হয়ে ছিন্নপত্রকে ক্যামেরার ভাষায় তুলে এনেছিলেন নিসর্গশিল্পী নওয়াজেশ আহমদ।

কবি জীবনানন্দ দাশের রুপসী বাংলার রূপকেও একইভাবে চিত্রিত করতে উদ্যোগী হন এবং প্রকাশ করেন ‘ধানসিঁড়ি নদীটি পাশে’ অ্যালবাম। এই দু’টি আলোকচিত্রের অ্যালবামে নওয়াজেশ চরিত্রের একটি নতুন দিক উন্মোচন করা যায়। তিনি নিসর্গনিবেদনকে আলাদা মাত্রায় উন্নীত করার জন্য কবির প্রেক্ষণবিন্দুতে ধরা পড়া নিসর্গকে আলোকচিত্রে ধরে মেলবন্ধন করে গেছেন।

আজ পারিল-নওয়াধা গ্রামে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের এই যে মিলনমেলা- নাগরিক চোখ দিয়ে গ্রামীণ নিসর্গ অবলোকন-উপভোগের ধারা, এর সূচনাটি সচেতনভাবেই করে গেছেন পারিলের রাজপুত্তুর নওয়াজেশ আহমদ।

তিনি আজীবন তার আরাধ্য করে নিয়েছিলেন যে নিসর্গের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্কটিই শেষ কথা। নিসর্গবিচ্যুত হয়ে মানুষ আসলে সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাছাড়া তিনি ভরজীবন প্রাণের শান্তি ও চিত্তের আনন্দই খুঁজে ফিরেছেন। তাদের পারিলের এ বাড়িটিতে যে পারিবারিক জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে, তাতে ড. নওয়াজেশের একটি বাণী পাথরে বাঁধাই করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে লেখা- এ প্রাচীন গৃহ থেকে কোনো কিছু অপসারণ করা যাবে না, শুধু আহরণ করা যাবে অপরিমিত ভালোবাসা প্রাণের শান্তি আর চিত্তের আনন্দ।

চিত্তের এই আনন্দ তালাশে নওয়াজেশ আহমদ মৃত্যুর পরও তিনি নিসর্গবিচ্যুত হননি, শুয়ে আছেন পারিল-নওয়াধা’র গাছ-বৃক্ষবেষ্টিত সুশীতল ছায়ায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।