কুষ্টিয়া থেকে ফিরে: কয়েকটি জেলার পৌর নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে বেড়িয়েছিলাম। কুষ্টিয়া নাম দেখে আগেই মনে মনে লালন শাহের আখড়া ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
ভারত উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত বাউল সম্রাট লালন একাধারে বাউল সাধক, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক-এককথায় চারণ শিল্পী। যিনি লালন সাঁই, ফকির লালন, লালন শাহ, মহাত্মা লালন নামেও পরিচিত।
কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে ছেঁউড়িয়ায় তার আখড়া অবস্থিত।
আখড়ার প্রবেশ মুখের দু’পাশে রয়েছে বিভিন্ন দোকান। রয়েছে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা, বাঁশি, একতারা, নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি কাঠের তৈরি নানা জিনিসপত্র। কয়েকটি দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে লালনের ভাস্কর্য, ছোটদের খেলনা।
সাড়ে ১৪ একর জায়গার ওপর নির্মিত আখড়ায় রয়েছে লালন একাডেমি ভবন ও কমপ্লেক্স, পাঠাগার, অডিটোরিয়াম, রিসোর্স সেন্টার ও লালন জাদুঘর।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে আছেন সাধক বাউল লালন শাহ। তার সমাধির পাশে রয়েছে পালক মা মতিজান ফকিরানী এবং বাহিরে পালক পিতা মাওলানা মলম শাহর সমাধি। মাজার কমপ্লেক্সে লালন শাহসহ মোট ৩২ জনের সমাধি রয়েছে।
মাজার তদারকি করেন খাদেম ফকির আলী শাহ। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি এবং মাথায় সাদা পাগড়ি। নিরলস খেদমত করে চলেছেন।
কথিত আছে, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে সাধক ফকির লালন শাহ জন্মগ্রহণ করেন। যদিও এ নিয়ে রয়েছে নানা মত।
সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু করলে আখড়ার খাদেম ফকির আলী শাহসহ বেশ ক’জন লালন অনুসারী জানান, লালন শাহের বয়স তখন আনুমানিক ১৬ বা ১৭ বছর, তীর্থ ভ্রমণে বের হয়েছেন। তীর্থকালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করেন।
মতিজান ফকিরানী নামে এক মুসলিম নারী নদীতে পানি আনতে গিয়ে দেখেন কলাগাছের ভেলার ওপর শুয়ে আছে বসন্ত আক্রান্ত এক কিশোর। দ্রুত তার স্বামী মাওলানা মলম শাহকে ডেকে দেখান মতিজান। মলম শাহ দেখেন, কিশোরের শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।
মুসলিম এই দম্পতির কোনো সন্তান ছিল না। তারা কিশোর লালনকে নিজেদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন।
লালন অনুসারীরা আরও জানান, সুস্থ হওয়ার পর লালন গুরু সিরাজ শাহের সান্নিধ্য পান। চলতে থাকে গান-বন্দনা, সাধন-ভজন। কিন্তু বাড়ি তার মনকে বার বার ডাকতে থাকে। সেই ডাকেই একদিন তিনি ফিরে যান তার নিজের গ্রামে। কিন্তু ‘মুসলিম পরিবারে খেয়ে লালনের জাত গেছে’ এই বলে স্বজনরা তাকে ফিরিয়ে দেয়।
তাইতো লালন বলেন-
‘জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা/
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তা না-না-না। ’
নিজের বাড়ি থেকেও গৃহহীন হয়ে পড়েন লালন। নিজের পরিবার স্বজন থাকতেও একা। তিনি আবারও ফিরে যান তার পালক বাবা-মায়ের কাছে।
সাধক লালনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। মহাগ্রন্থ আল কোরআন তার সম্পূর্ণ মুখস্ত ছিল, যোগ করেন ফকির আলী শাহ।
মাওলানা মলম শাহ প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর কোরআন তিলাওয়াত করতেন। একদিন লালন কোরআন তিলাওয়াত শুনে বললেন, ‘কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হচ্ছে না। ’
তবে লালনের গানগুলো বিচার করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, লালন সচেতন ভাবেই জাত-ধর্ম গোপন রাখতে চেয়েছেন।
লালন বলেন,
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কী রূপ/দেখলাম না এই নজরে।
১৮৮৯ সালের ৫ মে শিলাইদহের জমিদার হাউসের বোটে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে গিয়ে হাজির হন লালন। রবি ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে হাতে ধরে বসিয়ে দেন একটা চেয়ারে এবং পেন্সিল দিয়ে তৈরি করেন লালনের একটি স্কেচ। লালন তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সেখান থেকেই পাওয়া যায় লালনের স্কেচ। বর্তমানে সেটি ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
লালন শাহের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কখনও সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত না। তবে এটা নিশ্চিত যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানের প্রতি বেশ মোহিত ছিলেন। সাধক লালনের গানের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারেরও বেশি হবে।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর (পহেলা কার্তিক, ১২৯৭ বঙ্গাব্দ) শুক্রবার ভোরে মরমি সাধক লালন শাহ পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর আগেও রাতভর গান করেছিলেন তিনি।
‘পার করো হে দয়াল চাঁদ আমারে/
ক্ষমা হে অপরাধ আমার/
এই ভব কারাগারে...’
মৃত্যুর আগে এটাই ছিল সাধক বাউলের শেষ গান।
গান্ধীজীর চেয়ে ২৫ বছর আগে লালন শাহ মহাত্মা উপাধি পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৬
এটি