ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

খণ্ডলের মিষ্টি অপূর্ব সৃষ্টি

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৬
খণ্ডলের মিষ্টি অপূর্ব সৃষ্টি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেনী: চুলা থেকে মাত্রই নামানো হয়েছে উত্তপ্ত কড়াই। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেলো বিকিকিনি।

সবারই চাহিদা ধোঁয়া ওঠা গরম গরম মিষ্টির।

এ চিত্র ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের খন্ডলহাই বাজারের এক মিষ্টির দোকানের।

সাধারণত সারাদেশে ঠাণ্ডা মিষ্টি খাওয়ার চল থাকলেও ওই বাজারের খণ্ডলের মিষ্টি খেতে হয় গরম-গরম। ধোঁয়া ওঠা গরম এ মিষ্টি তাই স্বাদে ও বৈচিত্র্যে হয়ে উঠেছে অনন্য।

এমনকি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও চেখে দেখেছেন খণ্ডলের এ অপূর্বস্বাদের ‍মিষ্টি।

জানা যায়, গরম-গরম খণ্ডলের মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখতে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন খণ্ডলহাই বাজারে। সেইসঙ্গে দিনে-দিনে বাড়ছে এ মিষ্টির প্রচার ও খ্যাতি। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে প্রবাসীদের হাত হয়ে এ মিষ্টি যাচ্ছে দূর পরবাসেও।

প্রায় গত ৫০ বছর ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখে তৈরি হচ্ছে পরশুরামের খণ্ডলের মিষ্টি। তবে সময়ের চাহিদার কারণে একই নামে একাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। এতে করে অনেক সময় আসল খণ্ডল পেতে বিভ্রান্তিতে পড়েন ক্রেতারা।

খণ্ডলের মিষ্টির অতীত ঘেঁটে জানা যায়, স্বাধীনতার পরপরই স্থানীয় কবির আহম্মদ পাটোয়ারী বক্স মাহমুদ ইউনিয়নের খণ্ডল হাইস্কুলের পাশে ছোট একটি মিষ্টির দোকান দেন। ওই দোকানে কারিগর হিসেবে কাজ নেন কুমিল্লার যোগল চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তি। অল্পদিনের মধ্যেই তার তৈরি সুস্বাদু মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। একসময় এলাকার নামেই তা পরিচিত হয়ে ওঠে খণ্ডলের মিষ্টি নামে।

এরপর থেকে ধীরে ধীরে জেলায় বর্তমানে অনেকগুলো খণ্ডলের মিষ্টির দোকান গড়ে উঠেছে। তবে খণ্ডলের মিষ্টির আদি স্বাদ এখনো ধরে রেখেছে কবির আহম্মদ পাটোয়ারীর ‘খণ্ডলের মিষ্টি মেলা’।

খণ্ডলের মিষ্টির আদি কারিগর যোগল এখন বয়সের ভারে ন্যূজ্ব। ফলে তিনি আর এখন মিষ্টি তৈরি করেন না। দোকানি কবির আহম্মদও বয়সের কারণে আর ব্যবসা সেভাবে পরিচালনা করতে পারেন না।

কথা হয় খণ্ডলের মিষ্টির উদ্যোক্তা আমির হোসেনের সঙ্গে। গর্বের সঙ্গে তিনি জানান, ৯০ এর দশকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একবার পরশুরামে এসে এ মিষ্টি খান। এরপর তিনি যতবার ফেনী আসতেন এ মিষ্টি খেতেন। এ মিষ্টির প্রতি তার এ আগ্রহের কারণেই পরে সারাদেশে খণ্ডলের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি জানান, ঈদ-পূজা-পার্বণ-পরীক্ষা সবসময় তার বিক্রি ভালো। তখন দৈনিক এখানে ৯০ থেকে ১০০ কেজি মিষ্টি তৈরি করা হয়। অন্যসময় তৈরি হয় ৫০ থেকে ৬০ কেজির মতো।

তিনি আরো জানান, মিষ্টি খেতে জেলার বাইরে থেকেও আসেন অনেকে। এ মিষ্টি তৈরি করেই জেলায় প্রায় শতাধিত মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাদের দুই ভাইয়েরও সংসারও চলে মিষ্টির মাধ্যমে।

বর্তমানে আদি খণ্ডলের স্বাদ ধরে রেখে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন কবির আহম্মদের ছেলে বেলাল হোসেন ও আমির হোসেন।

আমির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তাদের প্রবীণ কারিগর যোগল ৬২ রকমের মিষ্টি তৈরি করতে পারতেন। তার মিষ্টি তৈরির দৃশ্য দেখতেই একসময় দোকানে ‍অনেক মানুষের সমাগম হতো।

বেলাল হোসেন জানান, এখনো প্রতিদিন বিভিন্নভাবে ও গাড়িতে করে দূর-দূরান্ত থেকে মিষ্টি খেতে লোকজন তাদের দোকানে আসেন। তারাও পরম আতিথেয়তায় গরম মিষ্টি খাওয়ান। বেশিরভাই গরম-গরম খণ্ডল মিষ্টি বাড়িতে নিয়ে যান।

তিনি আরো জানান, বর্তমানে বাজারে অনেক নামী-দামী মিষ্টি রয়েছে, যাতে নানা ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তাদের মিষ্টিতে ক্ষতিকারক কিছু মেশানো হয় না।

তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টি তৈরি আর কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তা নিয়ে  সংশয় রয়েছে তার। তবে বংশ পরম্পরায় এটি টিকে থাকবে বলে আশা করেন তিনি। এলাকার মানুষও চান তাদের এ মিষ্টি টিকে থাকুক।

তাদের দোকানে গিয়ে কথা হয় জাকির হোসেন নামে এক যুবকের সঙ্গে। তিনি এসেছেন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা থেকে। তিনি জানান, খণ্ডলের মিষ্টির কথা অনেক আগে থেকেই শুনে আসছেন। তাই সুযোগ করে গরম মিষ্টি খেতে চলে এসেছেন। বাড়িতেও নিয়ে যাবেন এ মিষ্টি।

তৈরির প্রক্রিয়া
বেলাল হোসেন জানান অপূর্ব স্বাদের এ মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া।

তিনি জানান, এ মিষ্টি তৈরিতে গরুর খাঁটি দুধ, সামান্য ময়দা ও চিনি ব্যবহার করা হয়। মিষ্টির সঙ্গে অন্য কোনো রাসয়নিক উপাদান মেশানো হয় না। দুধের সঙ্গে সামান্য ময়দা ব্যবহার করা হয় ছানাকে গাঢ় করার জন্য। প্রথমে দুধ ও ময়দার মিশ্রণ থেকে ছানা তৈরি করা হয়। এরপর ছানা থেকে তৈরি করা হয় মণ্ড, মণ্ড থেকে খণ গোলাকার মিষ্টি। এরপর সে মিষ্টি তেলে ভেজে তা চিনি দিয়ে তৈরি শিরায় ডুবিয়ে রাখা হয়।

তিনি জানান, প্রতিকেজি মিষ্টি তৈরি করতে ১০০ টাকার মতো খরচ হয়, আর তারা বিক্রি করেন ১৩০ টাকায়। তবে কেউ চাইলে ভিপি-পার্সেল করেও মিষ্টি পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৬
এসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।