ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

শৈশবেই জীবনচাকা ঘোরানোর সংগ্রাম

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
শৈশবেই জীবনচাকা ঘোরানোর সংগ্রাম ছবি-অনিক খান / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ময়মনসিংহ: দু’যাত্রী নিয়ে পন পন করে ছুটে এলেন হাবিব। রিচার্জেবল ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক।

বয়স বারো কী তেরো। একেতো অভাবের সংসার, তারওপর ঘরে সৎমা।

ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও রয়েছে পেটের দায়! তবুও নগদ আয়ের নিশ্চয়তায় শৈশবেই তাকে শুরু করতে হয়েছে জীবনের চাকা ঘোরানোর সংগ্রাম।

শিশু চালক বলে যাত্রীদের কেউ কেউ ভয় করে হাবিবকে এড়িয়ে যান। আবার অনেকেই সানন্দ্যে হাবিবের রিকশায় চাপেন। নিত্যদিন একটি স্বপ্ন নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় হাবিব।

ও দাঁড়াতে চায় নিজের পায়ে। নিজের খাটুনিতে উপার্জিত আয় জমা করে কিনতে চায় একটি রিকশা।

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া খেজুরতলা গ্রামে হাবিবের বাড়ি। পুরো নাম জুনায়েদ হোসেন আল হাবিব। বাবা সাইদুল ইসলামও রিকশা চালক। তিনিই কিনেছেন রিচার্জেবল ব্যাটারির রিকশা।

জ্ঞান হওয়ার আগেই মা-বাবা’র দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে। অভাব-অনটনের সংসারে তাই পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি হাবিবের।

অনাদর, অবহেলা হাবিবকে মাস দুয়েক যাবত রাস্তায় নামিয়েছে। এ রিকশা চালাতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির দরকার নেই। ঘুরাতে হয়না প্যাডেল। শুধু চার্জ ফুরালেই প্যাডেলে পা চালাতে হয় হাবিবকে।

দিন চারেক আগে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পা রাখতেই দেখা মেলে হাবিবের। যাত্রী না পেয়ে আরো ক’জন রিকশা চালকের সঙ্গে নিজের জীবনের ধারাপাতের গল্প বলছিলেন হাবিব।

উৎসাহে সেই গল্পে কান পাততেই মৃদু হাসেন। ‘ভাই, কই যাবেন?’ যাত্রী ভেবে হাঁক দেয় হাবিব।

ক্যামেরার ল্যান্স তাক করা দেখে ভুল ভেঙে যায় হাবিবের। ‘আপনেরা সংবাদিক। আমার একটা ফডো তুলুইন’, রিকশার প্যাডেলে পা রেখে বলতে থাকে এ কথা।

নিজের কষ্টের কথা তুলে ধরে হাবিব বলতে থাকে, আমার বয়স তখন চার কী পাঁচ বছর। মা-বাপের ছাড়াছাড়ি হইয়া যায়। এরপর লেহাপড়াত আর মন বয় (বসে) নাই।

ঘরেও হতাই (সৎ) মা। বাপও আদর করে না। সহাল (সকাল) বেলা বাপ রিকশা চালায়। আর বিকেল থেইক্যা সন্ধ্যা লাগাদ (নাগাদ) আমি চালাই।

রিচার্জেবল ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে খুব একটা পরিশ্রমের দরকার নেই। ব্যালেন্স আর মাপটা ঠিক রাখতে পারলেই চলে। তবে দক্ষ হতে সময় প্রয়োজন, এটাও স্বীকার করেন হাবিব।

তার কথায়- ‘অটোরিকশা ওয়ালাগর লগে থাইক্ক্যা ট্রেনিং লইছি। তারা ২০ টাকা, ৫০ টাকা দিতো। এরপর বাপ কয়দিন দেখাই দিছে। অহন নিজেই চালাইবার পারি। দৈনিক এক থেকে দেড়শ’ টাকা ইনকাম করি। ’

দূরের গন্তব্য তো বটেই, স্বল্প দূরত্বের হাঁটা পথে পৌঁছতেও অনেকের প্রিয় যান টানা রিকশা। অ্যানালগ এ রিকশার সঙ্গে নগরজুড়ে ইদানিং দাপট বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার।

আবার হাবিবের মতো গরিবের রোজগার ও সাধারণের যাতায়াতেরও অন্যতম বাহন এ রিকশাই।

ব্যাটারিচালিত বেশিরভাগ চালক এলোপাতাড়ি বা বেপরোয়া গতিতে ছুটেন। হাবিব সেই পথে যেতে নারাজ। একমাত্র উপার্জনের এ পথ ধরেই হাবিব যেতে চায় বহুদূর।

‘পড়ালেহা করবার পাই নাই। রিকশা চালাইতে চালাইতেই একদিন আমি নিজেই রিকশার মালিক হমু। সেই স্বপ্ন তো দেহি’ নিজের ভুবনে রঙিন স্বপ্নে বিভোর এ শিশু একদমে যেন বলছিলো এমন কথা।  

শিশু শ্রম সম্পর্কে ধারণা নেই হাবিবের। অমানবিক শ্রম জেনেও কেন এ কঠিন পথেই, উত্তর পেতে কালবিলম্ব হয়নি। ‘আমগর মতো গরিব পোলাপাইন তো কাম কইরাই খাইবো।

কারো কাছে হাত পাতমু না। এই লেইগ্যাই স্বাধীন পেশা বাইছ্যা নিছি’ বলে ছোট্ট হাবিব।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
এমএএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।