ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

৯৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বিউটি লাচ্ছি’

ফটো ও স্টোরি: দীপু মালাকার, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৬
৯৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বিউটি লাচ্ছি’ ছবি- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘কোর্ট-কাচারির দিকে আমু আর বিউটি লাচ্ছিতে আমু না, এইটা কোনো কথা হইল’, হাসিমুখে বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব জামিল উদ্দিন।

কোর্টে এসেছিলেন এক আত্মীয়ের মামলার শুনানিতে।

বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় সূর্যের চোখ রাঙানিতে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে তড়িঘড়ি করে এসে ঢোকেন বিউটি লাচ্ছি’তে।

কিছুক্ষণ পরই তার ক্লান্ত ও রোদেপোড়া চেহারাটায় প্রাণ ফিরে আসছে। সামনে রাখা লাচ্ছির দুইটি খালি গ্লাস। ‘পুলাপাইন বয়স থেইক্কা আইতাছি এই দুকানে। আজ আইলাম প্রায় ৬ বৎসর পর। কোর্টে এখনও ঢুকি নাই, ভাবলাম আগে খাইয়া ঠাণ্ডা হইয়া যাই, যা গরম পরছে রে বাবা!’ শার্টের উপরের দুই বোতাম খোলা অবস্থায় জামিল উদ্দিন বলছিলেন ঠোঁট মুছতে মুছতে।

বৈশাখের এই তীব্র ‍তাপদহে ভরদুপুরে এক গ্লাস বরফ কুচি দিয়ে ঠাণ্ডা লাচ্ছি বা লেবুর শরবত অথবা  বাটিভর্তি ঠান্ডা ফালুদা! এ সময় এর চেয়ে তৃপ্তি অন্য কিছুই হতে পারে না। গত ৯৪ বছর ধরে মানুষের তৃপ্তি মেটানোর এ কাজটি করে যাচ্ছে পুরান ঢাকার ৩০/১ জনসন রোডে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী পানীয় প্রতিষ্ঠান ‘বিউটি লাচ্ছি ফালুদা’।

পুরোনো ঢাকার রায়সাহেব মোড় থেকে জনসন রোড ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে কয়েক পা এগুতেই রাস্তার পশ্চিম পাশে মিলবে বিউটি লাচ্ছি। ১৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত জাকির হোসেন, বর্তমানে আছেন ম্যানেজার হিসেবে। ক্যাশ কাউন্টারে বসে টাকার হিসাব রাখতে রাখতে বলছিলেন দোকানের শুরুর দিককার কথা।

তার কাছেই জানা গেল, দেশ ভাগেরও অনেক বছর আগে ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয় বিউটি লাচ্ছির পথচলা। ১৯২২ সালে স্থানীয় আবদুল আজিজের হাত ধরে টং দোকানে লাচ্ছি বিক্রি দিয়ে শুরু এই বিখ্যাত পানীয় প্রতিষ্ঠানটি। তার লাচ্ছি সে সময়ে জয় করে নেয় এলাকাবাসীসহ হাজারো ভোজনরসিকের মন। ফলে শুরু থেকেই দোকানটিতে সবসময়ই ভিড় লেগেই থাকত।

কয়েক পুরুষ ধরে চলছে বিউটি লাচ্ছি। আজিজের মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে আবদুল গফফার। আর ২০০১ সালে আবদুল গফফার মারা যাওয়ার পর বংশ পরম্পরায় ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে জাবেদ হোসেন।


দীর্ঘ দিন ধরে একই কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জাকির হোসেন বলেন, এখানে কর্মপরিবেশ অনেক ভাল। যারা আসেন তারা সহজে এই প্রতিষ্ঠান ছাড়তে চান না। নিজেই পরিচয় করিয়ে দিলেন লাচ্ছি মাস্টার মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে। যিনি ৫০ বছর ধরে এখানে লাচ্ছি বানাচ্ছেন। লাচ্ছি মাস্টার বিশেষণটা অবশ্য ম্যানেজারই দিয়েছেন।

মো. আলাউদ্দিন জানালেন যুবক বয়স থেকেই আছেন এই বিউটি লাচ্ছির সাথে। দেখছেন প্রতিষ্ঠানের তিন প্রজন্মকেও। স্বাধীনতার আগে থেকেই একই গদিতেই বসে দই, চিনি আর বরফ দিয়ে বানাচ্ছেন লাচ্চি। বিকিকিনি সম্পর্কে তিনি জানান, চিনি আর বরফ দিয়ে বানান লাচ্চি এবং লেবু, চিনি আর বরফ দিয়ে শরবত। শরবত ১৫ টাকা , লাচ্চি ৩০ টাকা আর স্পেশাল বিট লবণের লাচ্চি ৪০ টাকা। ডায়াবেটিকস রোগীদের জন্য এই বিট লবণ বলেও জানান তিনি।

এখানে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ গ্লাস লাচ্ছি-শরবত বিক্রি হয় গরমের ওপর ভিত্তি করে জানালেন তারই সহযোগী মো. শহিদুল্লাহ। যিনি এই লাচ্ছি আর শরবত বানিয়ে এখানে কাটিয়ে দিয়েছেন ৩৫ বছর।

দোকানের একদম শেষ মাথায় একমনে বসে ফালুদা বানাচ্ছিলেন এক যুবক। ২ মিনিটের মধ্যেই ৮ বাটি ফালুদা বানিয়ে ফেললেন। তার নাম জসিম। তিন বছর ধরে কাজ করছেন বিউটি লাচ্ছিতে। ফালুদাই বেশি বানান। বললেন আপেল, আঙুর, আনার, শ্রীফল, খেজুর, কলা, দই, মালাই, আইসক্রিম, চিনির সিরা, নুডুলস আর সাবুর দানা, পেস্তা বাদাম আর ঘি দিয়ে বানান  ফালুদা। স্পেশাল ফালুদা ৮০ টাকা আর নরমাল ৬০ টাকা । দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ প্লেট নিয়মিত দোকানেই যায়। সেইসঙ্গে রয়েছে পার্সেল।

সপ্তাহের সাত দিনই খোলা থাকে জনসন রোডের এই ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছি। শুধু শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য এক ঘণ্টার বিরতি। এ নিয়ম অবশ্য অন্য দুই শাখায় নেই।

এর প্রথম শাখা খোলা হয় কাজী আলাউদ্দিন রোডে প্রায় ১৪ বছর আগে। মো. খোকন আছেন এই দোকানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে। জানালেন এর সঙ্গে আছেন ৩৫ বছর ধরে। মূল প্রতিষ্ঠানের মতোই লাচ্ছি, শরবত আর ফালুদার পাশাপাশি এখানে বাড়তি হিসেবে রয়েছে বিরিয়ানি আর মোরগ পোলাও। দামও প্রধান শাখার মতোই।

তবে শরবত, লাচ্ছি, ফালুদার দাম একটু বেশিই বনানী শাখায়। বনানীর ৯নং রোডের ৬৬ নং বাড়িতে  রসগোল্লার সঙ্গে যৌথভাবে বিউটি লাচ্ছি চালু হয় চলতি বছরের ২৬ মার্চ। তত্ত্বাবধানে রয়েছেন জাকির হোসেন, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তারও সঙ্গ ৩২ বছরের।

‍দাম বেশি প্রসঙ্গে জানালেন, এখানে দোকান ভাড়া অনেক। এখানে শরবত ৩০ টাকা, লাচ্ছি ৫০ টাকা আর ফালুদা ১২০ টাকা। তবে স্বাদ একই। বললেন, ‘আমি নিজেই তো বানাই। ৩০টা বছর জনসন রোডের দোকানেই লাচ্চি ফালুদা বানায়া আইলাম। এহানেও মানুষ ভালাই আইতাসে। সন্ধ্যার দিকে ভালই ভিড় হয়।
 

জাকির হোসেন জানান, পুরাতন হওয়ায় বিশেষ করে পুরান ঢাকায় এবং অনেক জেলা-উপজেলাতে বিউটি লাচ্ছির ভালো নাম-ডাক রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রোগ্রাম, বিয়ে, হলুদ, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদেরকে লাচ্ছি-ফালুদা বানাতে ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া যায়। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সরাসরি অনুস্থানেও তিনি অংশ নিয়েছেন বলে জানালেন জাকির হোসেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫, এপ্রিল ২৮, ২০১৬
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।