ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

১২৬ বছর ধরে যাদের জন্য মে দিবস!

ফটো ও স্টোরি: দীপু মালাকার, স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৩ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৬
১২৬ বছর ধরে যাদের জন্য মে দিবস! ছবি: দীপু মালাকার - বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: পহেলা মে মহান মে দিবস। বঞ্চনা, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় দিন।

ইতিহাস বলে, ১৮৮৬ সালের এই দিনে শ্রমের সময়সীমা ৮ ঘণ্টা করার দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’ চত্বরে শ্রমিকরা লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে বহু শ্রমিক হতাহত হন। প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গড়ে ওঠে মেহনতি জনতার ঐক্য। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। তারপর ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে মে দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এদিনে সরকারি-বেসরকারি সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে আসছে।

কিন্তু এই ১২৬ বছর ধরে কাদের জন্য এই দিবস? কাদের জন্য শুধু একটি দিনেই মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ, আলোচনা, মিটিং-মিছিল, এসি রুমের টক-ঝাল শো?

শ্রমিকদের ঘাম এখনো অনবরত ঝড়ছে শোষণ, বৈষম্যে আর পারিশ্রমিকের অন্যায্যতায়। শহরের পথেঘাটের শ্রমিকরা কেউই জানেন না- কী এই মে দিবস, কেন এই দিবস।


বাবু বাজার ব্রিজের নিচে রিকশা চালাচ্ছেন সিদ্দিকুর মিয়া। রিকশায় তার ওজনের প্রায় ৪/৫ গুণ পণ্য। তার উপরে প্যাসেঞ্জার বসে। পিছনে দুই ট্রাকের অনবরত হর্নে কথা বলতে চেয়েও পারলেন না।


এই বৃদ্ধর মাথায় এখনো জীবন সংগ্রামের বোঝা। বয়স যে সংগ্রাম বোঝে না। শারীরিক শক্তিটুকুই যেন বেঁচে থাকার সম্বল।


কর্ম পরিবেশে কোনো নিরাপত্তা নেই। নূর নবী আর আলাউদ্দীন শেখ দুই ভাই। রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন বছর পাঁচেক। কী কারণে মে দিবস, এদিন কী হয় জিজ্ঞেস করতে বলেন, শুনছিলাম পল্টন প্রেসক্লাবের সামনে অনেক চিল্লাচিল্লি হয়। মিটিং-ফিটিং হয়।


গাড়ির গ্লাসে ড্রাইভার করিম বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। ফল বোঝাই ট্রাক নিয়ে মানিকগঞ্জ যাচ্ছেন। যানজটের কারণে কখন পৌঁছাবেন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সন্ধ্যার ভেতরে গাবতলীর বাসায় যেতে হবে। জানালেন, ছোট ছেলেটার জ্বর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। স্ত্রী একটু আগেও ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তার যে অবস্থা বাসার ফেরার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তার মধ্যে পথে পুলিশি উৎপাত, চাঁদা তো আছেই। শ্রমিক দিবসে ছুটি পাবেন, এটা জানেন তিনি।


বাদামতলিতে দিনমজুরদের ফলের ঝুড়ি বহন করতে হয় নৌকা থেকে গুদামঘর পর্যন্ত। গুদামঘর আবার ৪ তলায়। ঝুড়ি প্রতি পাওয়া যায় ১০ টাকা। ৪০/৫০টা ঝুড়ি নিতেই সকালের শক্তি শেষ হয়ে যায়। দুপুরে একটু জিরিয়ে আবার বিকেলে নামেন অন্য কাজে। বিকেলে যা পাবেন তাই করবেন।


মঞ্জু ইসলাম অবশ্য আগে কন্ডাক্টরি কাজ ছেড়ে বর্তমানে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে ভালোই আছেন। বেলা প্রতি ৮০ টাকা জমা দেন, দিন চালালে ১৬০ টাকা। মাস শেষে নিতান্তই কিছু জমাতে পারেন, এতেই খুশি তিনি।


রাজধানীর সদরঘাট-গাজীপুর রুটের সুপ্রভাত গাড়ির চালক তিনি। এক মনে বিড়বিড় করছিলেন, দুনিয়ার সব চাইতে খারাপ পেশা এটি। ছোট নাই বড় নাই, পাবলিক গাইল দেয়। বলে অবশ্য নিজেও একটা গালি দেন!


বাসের হেলপার নাসিরের চোখমুখে আরও তিক্ততা। সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন রোজগারের উদ্দেশ্যে। ২ বছর যেতে না যেতেই তার আর মন টেকে না এই পেশায়। আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, বাড়ি গিয়ে ক্ষেত-খামারে কাজ করা শতগুণে ভালো।


নাজমুলের বয়স মাত্র ১০। রায় সাহেব বাজারে সবজি বিক্রি করে বড় ভাইয়ের সঙ্গে। স্কুলে যাওয়া হয় না তার। অথচ তার পেছনেই চিল্ডেন গার্ডেন স্কুলের বিজ্ঞাপন।


এ শ্রমিকদের গল্প কখনও শেষ হবে না। যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকেই আবার শুরু হবে। হোক না সে গ্রীষ্মের মে দিবসের তপ্ত দুপুরে মালবাহী ট্রাকের উপরে। সম্বল যেখানে একটি সংগ্রামী লাল গামছা।


মহান মে দিবস। সফল হোক।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩২ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৬
কেআরএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।