হিমাঙ্কের কাছাকাছি থাকা শীত উপেক্ষা করে দানিয়ুবের তীরে নামতেই বাড়তি স্বাগত জানালো শীতের বাতাস। সাইবেরিয়া থেকে বয়ে আনা ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপুনি ধরতে সময় লাগলো না।
নদী... কথাটি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই কূলে দীগন্ত বিস্তৃত সবুজের মাঝে এক অপরূপ জলের ধারা। তাতে কুলু কুলু ঢেউ, আর নদীর মাঝে পাল তোলা নৌকা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীতো এমনই। বরাবর জানা, নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা। আর নদী যখন এই বন্দর, শহর আর নগরের খপ্পড়ে পড়েছে তখনই তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। কিন্তু দানিয়ুবের ক্ষেত্রে তা মোটেই সত্য হয়ে ধরা দিলো না।
বরং আলো-ঝলমল-পানি টলমল এক নদী দানিয়ুবকেই দেখলো সবাই।
এখানে সব আছে- নদীর স্বচ্ছ জল, জলের স্রোত, পানির কুলুকুলু ধ্বনি, নদীতে বড় বড় জাহাজ, সেই কোথায় শুরু হয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হওয়া। শুধু নেই দুই ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
তাতে কি? এদের আছে আলো। রাতের দানিয়ুবে সেটাই দেখা যায়। দেখা যায় শত রঙের আলোয় কতই না চমক নদীর বুকে। আর সে আলোগুলো আসছে নদীর দুই ধারে গড়ে তোলা ভবনগুলো থেকে, নদীর ওপর দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া সেতুগুলো থেকে।
বুদা আর পেস্ট। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদী দানিয়ুব। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড, এতে বিচ্ছিন্ন হয়নি বুদাপেস্ট। বরং কী এক অদ্ভুত কারণে মনে হবে নদীটিই যেনো জোড়া দিয়েছে বুদা আর পেস্টকে। আর তাতেই একসঙ্গে হয়ে তারা হয়েছে বুদাপেস্ট। ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির এটাই রাজধানী শহর।
বিশ্বের দেশে এমন নদী আরও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে হাডসন কিংবা ইস্ট রিভার দু’টিকেই বাঁধা হয়েছে এমন আয়োজনে। লন্ডনের টেমসকেও নগরীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করা হয়েছে, জাপানের টোকিওর সুমিদা নদীরও একই চেহারা। ভারতের আহমেদাবাদে সবরমতিকে দুই কূলে বেঁধে নদীকে দেওয়া হয়েছে অন্যরকম রূপ। এমন আরও হয়তো ডজন ডজন উদাহরণ মিলবে। এই দানিয়ুবকেই অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতেও বাঁধা হয়েছে একই সৌন্দর্যে।
ভূগোলে রয়েছে, দৈর্ঘ্যে ইউরোপে ভলগার পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী এই দানিয়ুব যা বয়ে গেছে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের পুরোটা জুড়ে দশটি দেশের বুক চিরে। বিশ্বের আর কোনও নদীই কিন্তু এতগুলো দেশকে ছোঁয়নি। সেই জার্মানিতে কৃষ্ণবনের কাছে বার্গ ও ব্রিগাচ নদীর মিলিত স্রোত থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণ-পূব বরাবর ২ হাজার ৮৬০ কিলোমিটার যেতে অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, মোলদোভা আর ইউক্রেনকে ছুঁয়ে কৃষ্ণ সাগরে বিলীন হয়ে গেছে।
কিন্তু পথে পথে গড়ে দিয়ে গেছে শত শত নগর-শহর-বন্দর। বলা হয় একসময় রোম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো এই দানিয়ুবের দুই পাড়।
আগেই বলেছি বুদা ও পেস্টকে জোড়া দিয়েছে এই দানিয়ুব। হাঙ্গেরির এই রাজধানী শহরটির দুই অংশ বুদা ও পেস্ট। ক্রুজশিপে এই নদী ধরে যেতে থাকলে দুই ধারের নানা কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
বুদা অংশে বুদা ক্যাসল বা ক্যাসল হিল, সেন্ট ম্যাথিয়াস চার্চ, জেলার্ট হিল, ফিশারম্যান'স ব্যাসন এমন ভবনগুলো দৃষ্টি কাড়বে। আর পেস্ট অংশে গোথিক ধাচে নির্মিত হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট ভবন চোখ আটকে রাখবে দীর্ঘক্ষণ। চোখে পড়বে একূল-ওকূলকে অটুট বন্ধনে আটকে দেওয়া সেতুগুলো। এর মধ্য চেইন ব্রিজ আর লিবার্টি ব্রিজ চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। ব্রিজগুলোতে সজ্জিত আলো রাতের দানিয়ুবকে দেয় এক অপরূপ সৌন্দর্য।
এসব ব্রিজের ওপর দিয়ে হলুদ ট্রামগুলো যখন এদিক থেকে ওদিক ছোটে তখন তার ছায়া পানিতে পড়ে সে সৌন্দর্যকে দেয় বাড়িয়ে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে স্থানীয় সময় রোববার সন্ধ্যায় যারা বুদাপেস্ট পৌঁছান তাদের জন্যই ছিলো এই ক্রুজ ডিনারের আয়োজন। এতো সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি মজাদার রাতের খাবার ছিলো সত্যিই উপভোগ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১৬
জেডএস/এমএমকে