রাজধানী থেকে আসা সঙ্গীর সেখানে পৌঁছুতে বেরিয়ে গেলো আরো মিনিট পাঁচেক। গলা শুকিয়ে কাঠ, থুতু গেলারও জো নেই।
এর চেয়েও উঁচু পাহাড় চড়ার অভ্যাস আছে। কথায় আছে, অনাভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস- এখানেও হলো তাই। এরপর অবশ্য বিদ্যা ফিরে এসেছে, শরীরও সয়ে নিয়েছে। শুধু সাতসকালে তীব্র শীত তাড়ানো কাপড়-চোপড়গুলো এক এক করে ঢুকে গেলো ব্যাকপ্যাকে। পাহাড় চড়ে রক্তে যেনো আগুন ধরে গেছে- কাপড় রাখাই দায়!
ব্যাগে আগে থেকেই ছিলো, না নিলেই নয় এমন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। এর বেশিরভাগই শীতের কাপড়। কারণ, যেতে হবে বহুদূর। এই বেলা পাহাড় শীত তাড়িয়ে দিলেও, রাতে সেই আবার সদলবলে ডাক পাঠাবে। এরসঙ্গে প্রায় আড়াই কেজি ওজনের ল্যাপটপ। নিতেই হলো! এক নমস্য ফটোগ্রাফারের নির্দেশ, ছবি তুলে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে দ্রুত যে কাজটি করবে- সংরক্ষণ (ব্যাকআপ)।
সব মিলে ব্যাগের ওজন সাত-আট কেজির কম হলো না! অবস্থা তখন ম্রো নারী ও পুরুষদের মতো। থ্রুং (বাঁশের তৈরি লম্বাটে গোল ঝুড়ি) ভর্তি করে কাঠ বা পানি নিয়ে পাহাড়ে ওঠা-নামা করতে হয় তাদের। তখন থ্রুংয়ের ভার সামলানোর জন্য হাঁটতে হয় সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পিঠ কুঁজো করে। পা ফেলতে হয় ছোট ছোট ধাপে। একটু-ওদিক হলেই শেষ!
যাহোক, পাহাড়ে চড়েই চোখ জুড়িয়ে গেলো। আহা! চারপাশে পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের উপরে পেনসিলে টানা দাগের মতো আরও পাহাড়। মায়ের কোলে বাচ্চারা যেভাবে মাথা দিয়ে রাখে- নীল আকাশের গায়ে আলতো করে চূড়াগুলো সাজানো যেনো। দূর থেকে সবুজের ঢেউ ছুটে আসে। কখনও ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে ডাল-পালার ভিড়ে লুকিয়ে পড়ে পাখি।
আলিকদম সদর থেকে বুধবার (১১ জানুয়ারি) আমতলী বাজারে নামিয়ে দেয় ইজিবাইক। সূয্যিমামা উঠি উঠি করছে। পূর্বদিকের রাস্তা ধরে ডানে গুইহাপ ঝিরি (স্থানীয় ভাষা) রেখে উত্তর-পূর্বদিকে যাত্রা শুরু হয়। পেছনে ফেলে যাই টেলিঅপারেটরদের নেটওয়ার্ক আর ম্রো শিশুদের বিস্মিত চোখ। রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।
জায়গায় জায়গায় গাছ কেটে রাখা। কোথাও ছনের গাদা। কলা-শিম-পেঁপে ক্ষেতে কাজে নেমে পড়েছেন পাহাড়িরা। পিঠে ছোটটিকে ঝুলিয়ে বড় দু’টিকে স্কুলের পথে নিয়ে চলেছেন ইউপি সদস্য মা।
যাত্রাপথে ভাইপোর সঙ্গে দেখা হয় ২৯১ তৈনফা মৌজার হেডম্যান মেন পুং ম্রো’র। হেডম্যান হলেন দলের ৬৮। উনষাটের আগুলা ত্রিপুরা (টিপরা) একজন কারবারি। পাড়াপ্রধানদের এখানে বলে কারবারি। প্রধানদের নামানুসারে পাড়ার নাম হয়। যেমন, আগুলা কারবারি পাড়া। ঢাকাবাসী বাদে দলের তৃতীয় সঙ্গী হলেন কমলাই ম্রো। তিনি ম্রো বাহিনীর একজন সদস্য। সঙ্গে আরও চলেছে চা, চিনি, বিস্কুট, শুকনো খাবার, তেল, পেঁয়াজ, নুন প্রভৃতি আর দু’টি মুরগি। সিমেন্টের বস্তার ব্যাগে দু’দিকে দু’টো ফুটো করে মাথা বের করে দেওয়া হয়েছে। সফরসঙ্গীদের মধ্যে ওরাই কেবল বেশ আয়েশে চলেছে!
হেডম্যান হেড বলেই সবার আগে আগে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কষ্ট হয়? সামনে দোকানে গিয়ে বিশ্রাম করবো।
এই পাহাড়ঘেরা পরিবেশের মাঝখানে দোকান! হ্যাঁ, বুলু কারবারি পাড়ার নিয়াক্রিং ম্রো দোকান সাজিয়ে বসেন টিলার উপর। মিলবে- চা, বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুর, কলা, ডিম, এনার্জি ড্রিঙ্ক, জুস প্রভৃতি। এদিন বসেননি।
খোঁজ নিলে ঘাড়ে লম্বা লাঠি ঝুলিয়ে কাজে যাওয়া ম্রো যুবক জানান, নিয়াক্রিংয়ের ভাইপোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। এজন্য পাওয়া যাবে না তাকে। অগত্যা একটু গলা ভিজিয়ে আবার রওনা। বেশি পানি খাওয়াও মুশকিল- পাহাড়ে চড়লে পেট ব্যথা করে। ততোক্ষণে রোদের তেজ বাড়ছে। শরীরের যেখানে পড়ছে চড়চড় করছে। যতো পাহাড় বেয়ে উপরে উঠি সূর্যের সঙ্গে মাথার দূরত্ব যেনো একহাতে নেমে আসে। ঢালু পথ বেয়ে নামার সময় জুতো সামনের দিকে দুই-তিন ইঞ্চি বেরিয়ে আসতে চায়। আবার খাড়া উঠলে যেনো ছিড়ে বেরিয়ে আসবে। মুখ থাকলে নিশ্চয়ই বলতো, তোর চাকরি আর করবো না!
হাঁটার গতি কমিয়ে হেডম্যান পাশে এসে বলেন, রেংমিটচা ভাষা হলো ম্রোদের (মুরং) একটি ভাষা। এক জাতি কিন্তু ভাষা আলাদা। বিভিন্ন জায়গার থাকা, মানুষ ও ভাষার সঙ্গে মেশার ফলে এমনটি হয়েছে।
‘যেমন- দমরং, সাংমা, তামছা, রেংমিটচা, মুরুংচা প্রভৃতি ভাষাগুলো ম্রোদেরই ভাষা। কোনোটি একটি আরেকটির কাছাকাছি; কোনোটি আবার বেশ আলাদা। রেংমিটচা এরকমই একটি আলাদা ভাষা। তবে এখন দমরং ভাষাটি বেশি চলে। ’
আগুলা কারবারিও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। জানালেন, তাদের টিপরাদের মধ্যেও রয়েছে এরকম আলাদা ১৩টি ভাষা। যেমন- পাঞ্জি, জলাই, উনচই, ওয়ারেং, কাইসমি, লাইদং, পানদং প্রভৃতি।
বেলা বাড়ে। পথ আরও কঠিনতর হয়। উত্তরে ঠাণ্ডা ঝিরি, দক্ষিণে হাতি ঝিরি, পুবে পাহাড় ও খাইদালা এবং পশ্চিমে জেন্তা ঝিরি রেখে পা এগোয়। চড়াই-উৎরাই আঁকা-বাঁকা পথগুলো সিঁড়ির মতো কেটে কেটে রাখা, যেনো পথ চলতে সুবিধা হয়। সবজায়গায় নেই কিংবা গাছের শুকনো পাতা পড়ে পথ বুঁজে গেছে। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। একটু সরলেই সোজা গড়িয়ে তৈন খালের জলে।
দুপুর গড়ায়। পাহাড়ের গা বেয়ে পা পড়ে তৈন খালের শীতল জলে। আরও আধঘণ্টা একনাগাড়ে পথ চললে খালের উত্তর দিকে হেডম্যান পাড়া, মানে তার নিজের পাড়া এবং দক্ষিণদিকে আগুলা কারবারি পাড়া। শীতকাল বলে জেগে ওঠা চরে আগুলা দা’র জামাইয়ের দোকান। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পাড়ায় উঠবেন বলে জানান হেডম্যান। সেখানে দু’জন রেংমিটচা ভাষা জানেন। একজন হেডম্যান নিজে, অন্যজন পাড়া কারবারি আশি ছুঁই ছুঁই হক্কে ম্রো।
খালে পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী স্রোত। হাঁটুপানিতে মৃদু স্রোত কেটে কেটে এগিয়ে চলি। পাড়জুড়ে সরিষা ফুলের হলুদ জোয়ার।
হঠাৎ হঠাৎ কিছু একটা বলে একমুখ হাসি নিয়ে বলেন, রেংমিটচা বললাম। হাতে ফুল তুলে বললেন, রেংমিটচা ভাষায় এটাকে বলে খেলেং।
বোঝা গেলো, তাকে রেংমিটচা ভাষায় পেয়ে বসেছে!
** ‘পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো’
** রেংমিট্চা: বাংলাদেশে যে ভাষায় কথা বলে মাত্র ২৫ জন!
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৭
এসএনএস/জেডএম