দাদিরও (তিনওয়াইয়ের স্ত্রী) ব্যস্ততা কম নয়। বাড়িতে অসুস্থতা ও অমঙ্গল দূর করতে বিশেষ পূজা হবে।
জুম চাল-কুমড়া ও দেশি মুরগিতে জমজমাট ভূরিভোজের পর বুধবার (১১ জানুয়ারি) হেডম্যান পাড়া থেকে পরের পর্বের যাত্রা শুরু হয় তৈন খালের দক্ষিণ দিক ধরে। সূর্য ততোক্ষণে পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। দ্রুত পা চালাতে হবে। আঁধার নামার আগেই পৌঁছে যেতে হবে তিনওয়াই কারবারি পাড়ায়। নইলে পুরো রাত পাহাড়ি জঙ্গলে!
অর্ধেকটা পথ তৈন খালের মৃদু উজান ঠেলে এবং অর্ধেকটা পথ পাহাড়ি খাড়া পথ। বন-জঙ্গল তো রয়েছেই। একদম চূড়ায় ২৫ পরিবার নিয়ে পাড়া। গোধূলি বিকেল করে কারবারির বাড়িতে পা পড়ে।
কে এলো দেখার সময় নেই কারও। ঘরে আলোও জ্বালায়নি কেউ। দু’টি হাত এসে কেবল হাতে বোনা পাটি ও কম্বল দিয়ে যায়। নিজেই পেতে ২৯১ তৈনফা মৌজার হেডম্যান মেন পুং ম্রো (৬৮) টানটান হয়ে শুয়ে পড়েন। দেখাদেখি আমরাও। ঘরময় চোখ ঘুরে বেড়ায়। ঘর তো নয়, একটি হস্তশিল্পের যাদুঘর!
আগুলা ত্রিপুরা দা (আগুলা পাড়ার প্রধান) ফিস ফিস করে বলায় বোধগম্য হয়, একটু পরই মূল পূজা শুরু হবে। চলছে শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতির তোড়জোড়।
পূজা শেষ হয়। একে একে তিনটি কুপি জ্বলে ওঠে। একটি বামহাতে নিয়ে অতিথিদের দিকে এসে ডানহাত মিলিয়ে বুকে ছোঁয়ান। এখানে এমনই নিয়ম। এরপর ম্রোদের ঐতিহ্যবাহী পানীয় ‘আরগা’ এগিয়ে দিয়ে কুশলাদি সারেন। এটিও তাদের রীতি।
এরপর নৈশভোজ পর্ব। পাহাড়ে সন্ধ্যা হতেই খেয়েদেয়ে বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। এদিন যাদের জন্য পূজা-প্রার্থনা, তারা প্রসাদসহ খেয়ে নিলেন আগে। তিনওয়াই কারবারি বসলেন পাড়ার বয়ঃজেষ্ঠ্য পূজারি সওনাই ম্রো (৭৩), তিন অতিথি ও হেডম্যান পাড়ার কারবারি হক্কে ম্রো-কে (৭৮) নিয়ে।
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। হেডম্যান খবর পাঠিয়েছিলেন আগেই। ছোট্ট টর্চ হাতে ঘরে ঢুকলেন তিনওয়াই কারবারির আত্মীয়া কুমরাও ম্রো (৬৪)। কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বেন বছর সাতচল্লিশের ম্রো নারী কমনিং ও কারবারির চাচাতো ভাই রেংলক ম্রো (৫৪)। প্রত্যেকেই রেংমিটচা জানেন।
আকাশে পৌষালি পূর্ণিমার চাঁদ। বাইরে বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয়, এই বুঝি হাতে এসে ধরা দেবে। রুপালি আলোয় ভিজে যাচ্ছে পাতা, ফুল আর দোচালা টিনের চাল। এ অনাবিল সৌন্দর্য কেবল দু’চোখে ধরা যায়, ক্যামেরার ফ্রেমে নয়!
ভেতরে বাটিতে চা নিয়ে ফায়ার প্লেস ঘিরে জড়ো হন বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচা ভাষা জানা কজন- হেডম্যান, হক্কে, সওনাই, তিনওয়াই ও কুমরাও। কমনিং ও রেংলক তখনও এসে পৌঁছাননি।
দোভাষী হিসেবে রয়েছেন- হেডম্যান ও আগুলা দা। তাদের মধ্যে হেডম্যান রেংমিটচা ও দমরং (ম্রোদের ভাষা) জানেন। বাংলা জানেন মোটামুটি, তবে আরগা পেটে পড়লে সেটুকুও ভুলে যান। আগুলা দা দমরং ও বাংলা ভালো জানেন কিন্তু রেংমিটচা জানেন না।
তারা নিজেদের মধ্যে কথা শুরু করে দেন। সেটি দমরং না রেংমিটচা- সেই ভাষার সুলুখ সন্ধানে যাওয়া ঢাকাবাসীর বোঝা সম্ভব হলো না। স্বাভাবিক। হেডম্যানকে অন্যদের কিছু জিজ্ঞেস করার কথা বললেই বলেন, আমি বলছি তো রেংমিটচা ভাষা।
একই কথা দু’বার বলেন। বোঝা গেলো, আরগা ইফেক্ট- তাকে এই রাতে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা বৃথা।
তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায়- বাংলায় প্রশ্ন পাড়া হচ্ছে আগুলা দা’র কাছে, তিনি সেটি দমরং ভাষায় বলছেন হেডম্যানকে, রেংমিটচা ভাষায় হেডম্যান সেটি পাড়ছেন সবার উদ্দেশ্যে। উত্তরও ফিরে আসছে একই কায়দায়- তিনটি ভার্সন ঘুরে।
তাতে যা পাঠোদ্ধার করা গেলো, ব্রিটিশ পিরিয়ডে এ পাড়ায় ২১/২২ পরিবার ছিলো যারা প্রত্যেকেই রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতেন। পরে ধীরে ধীরে দমরং, দওপ্রেং ভাষাভাষি ম্রো-রা আসেন বিভিন্ন জায়গা থেকে। রেংমিটচা ভাষাভাষীদের অনেকে মায়ানমার, এবং আরও গভীর পাহাড়ি বনে চলে যান বিভিন্ন সময়ে। অনেকে মারা গেছেন। বর্তমানে এ অঞ্চলে দমরং ভাষার চল বেশি। এর মধ্যে তিনওয়াই পাড়ায় রেংমিটচা ভাষাটি মনে রেখেছেন মাত্র পাঁচজন।
কুমরাওয়ের স্বামীও রেংমিটচা জানতেন। তিনি মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো।
প্রশ্ন ছিলো, রেংমিটচারা আলাদা জাতি বা গোষ্ঠী কিনা। আড্ডায় অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই চল্লিশোর্ধ্ব। সত্তরের ঘরেরও রয়েছেন। সবারই মত, তারা ভাষাটি বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শিখেছেন। পাশাপাশি অন্য ভাষা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বললেও, রেংমিটচা ভাষাতেই বেশি কথা বলতেন। রেংমিটচা আলাদা কোনো আদিবাসী গোষ্ঠী নয়, তাদের বাপ-দাদারা ম্রো (মুরং) ছিলেন।
রেংমিটচা ভাষা অঞ্চলভেদে ম্রোদের অনেকগুলো ভাষার মধ্যে একটি বলে তাদের ভাষ্য।
শেষ দিকে গুটি গুটি পায়ে রেংলক এসে হাত মিলিয়ে বসে পড়েন। কিছু না বলে বসে থাকেন মুখে সরল হাসি নিয়ে। কমলিং একটু অসুস্থ, সকালে দেখা করবেন বলে খবর পাঠান। এদিকে, কারবারি হক্কে ম্রো আরগা খেয়ে এক কোণায় বসে। কোলে দুই হাত একজায়গায় করে আর মাথা তুললেন না। মাঝে একবার হুকোতে টান দিলেন। তার কাছ থেকেও সকালে শুনতে হবে।
বাইরে জোছনার বান ডাকলেও ঘরে কুপির আলো ছাড়া আর কিছু নেই। শীত ঠেকাতে দরজা-জানালা এঁটে বসেছেন সবাই। এসময় তাদের কথাবার্তা অর্থাৎ রেংমিটচা ভাষা ভিডিও করলে অন্ধকার ছাড়া কিছুই আসবে না! কাজেই ভিডিওর জন্য সবাইকে পরদিন সকালে আবার জড়ো হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
রাত সাড়ে তিনটের দিকে প্রাকৃতিক ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। জীবনে বহু চাঁদ, বহু পূর্ণিমা দেখেছি কিন্তু পাহাড়ে ওই রাতের চাঁদের মতো এতো সুন্দর রুপালি আলো আর দেখিনি। একটি শব্দই মনে আসে, অপার্থিব!
ফিরে এসে আর দু’চোখের পাতা এক হয় না। অনেকটা কারণ ওই মোহময় চাঁদের জন্য তো বটেই; এছাড়া সকালে উঠে হারিয়ে যেতে বসা রেংমিটচা ভাষাটি ভিডিও ধারণ করতে পারাটিও কম নয়!
**জুম চাল-কুমড়ায় ভোজ ও রেংমিটচাবৃত্তান্ত
**পাহাড়-ঝিরি পেরিয়ে রেংমিটচার টানে
**‘পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো’
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৭
এসএনএস/জেডএম