দিনপঞ্জিতে পয়লা ফাল্গুন, অর্থাৎ বসন্ত এসে গেছে। চারদিকে কচি পাতার হাসিতে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার কথা।
পাহাড়ি ঝিরির মতো আপন মনে বয়ে চলা ঝিরঝিরে দখিন হাওয়া কই? কেউ কি তারে ডেকেছে ফাগুনের নিমন্ত্রণে? তবে কার লিপি হাতে ফাগুন এলো? এতো পালাবদলের মাঝে বসন্তদূত কোকিলেরও মনে বড় দুঃখ। ইদানিং কোথাও দেখি না তারে। তবে তার ব্যাকুল কুহুতান কোন দেশে শোনা যায়?
তবু ফাগুন এসেছে ধরায়, গোলাপ জবা পারুল পারিজাতের বুকের পরে। কোথাও ফুটে থাকা অশোক-কিংশুকের কথা ভেবে মনে রঙ লাগে আকারণ সুখে। বসন্ত বরণে দূর থেকে চেয়ে থাকবার মতো তরুণীটি আজ বাসন্তী শাড়িতে বেরিয়েছে। জমাট খোপাটি তার হলুদ গাঁদায় মোড়া। দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। কাছে যেতে লাগে না, তের নদীর এপার থেকেও ঝনঝন শব্দ ঠিক বুকে বাজে। তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে হৃদয়পুরের দিকে নিয়ে যাওয়া তরুণের পরনে লাল। অন্যহাতে তার ফুলভর্তি গোটা বাগান। স্মিত হেসে হঠাৎ হঠাৎ কি যেনো বলে, শুনে বাসন্তী হাসি দিগন্ত পেরোয়!
‘দিল তারে বনবীথি কোকিলের কলগীতি,
ভরি দিল বকুলের গন্ধে...। । ’
এমন নবীনের আনন্দে বেখেয়াল ফাগুন ঠিক এসে যায় ছন্দে। মাধবীর মঞ্জরীঘ্রাণ মনে পড়ে যায়। আকাশ ফট করে আরও নীল হয়ে যায়। হুট করেই যেনো চারদিকে ফুটে ওঠে লাল পলাশ। ক্লাইমেট চেঞ্জ রয়ে যাক সভা-সেমিনারে। কে বলে ফাগুন আসেনি?
‘বাণী মম নিল তুলি পলাশের কলিগুলি,
বেঁধে দিল তব মণিবন্ধে...’
ফাগুন তথা বসন্তকে বলা হয় বাঙালির প্রেমের ঋতু। ইংরেজি মাসের তারিখ অনুযায়ী আধুনিক ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’র ঠিক একদিন আগে হাজির হয় ফাগুনের প্রথম দিবস। প্রাকৃতিক রূপ-রস-গন্ধের মহাসমারোহের কারণেই তাকে প্রেমের ঋতু বলাটা মোটেও অত্যুক্তি হয় না। এ ঋতুতে প্রকৃতি নিজেকে অন্যরূপে সাজিয়ে তোলে। বাগানজুড়ে ফুল-ফল, শাখে শাখে নতুন পাতা, দিকে দিকে পাখির কলতান, দখিন হাওয়া, নতুন প্রাণ, অনাবিল প্রেম- এমনি এমনি তো আর ঋতুরাজ আখ্যা পায়নি বসন্ত!
বসন্ত কেবল এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলেই নয়, পশ্চিমেও কম ছুঁয়ে যায় না। যেটি কিংবন্দন্তী সঙ্গীত শিল্পী জন ডেনভার যেনো সবচেয়ে গভীরভাবে বলেছেন, ‘ইউ ফিল আপ মাই সেনসেস, লাইক দ্য মাউন্টেইনস্ ইন স্প্রিং টাইম...’।
অর্থাৎ আমাদের বসন্তদিন, তাদের স্প্রিং টাইম। বিশ্বের দিকে দিকে নানাভাবে বসন্ত বরণ বা বসন্ত উৎসব পালিত হয়। ফিরে আসি আপন ফাগুনে। বাঙালি বসন্তকে গান-কবিতা-আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে বরণ করে নেয়। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, ফাগুন সবচেয়ে প্রস্ফুটিত হয় তরুণ প্রাণে, নবীন আনন্দে।
এখানে একটি মজার বিষয়, তরুণ প্রাণ যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন নবীন আনন্দের কথাও। মানে আনন্দকে তিনি বয়সে বেঁধে রাখেননি। শীতের পর বৃক্ষরাজি যেমন পুরনোকে বিদায় দিয়ে কচিপাতার নবীন আনন্দে মেতে ওঠে, ঠিক তেমনি সব প্রাণে নতুনের আগমনই বসন্ত। বসন্ত মানে নতুন, বসন্ত মানে আনন্দ। ‘সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা’।
বসন্তে দিকে দিকে গান হবে, কবিতা হবে, প্রেম হবে, খুনসুঁটিও কম হবে না। প্রেমিকার খোপায় গোঁজা ফুল সবার অলক্ষ্যে পড়ে যাবে, সেটি কেবলই দেখতে পাবে প্রেমিক। বুকভরা প্রেম নিয়ে ধুলোঝেড়ে সেটি আবার তুলে দেবে যথাস্থানে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে প্রেয়সী। এরপর শুধু দুইজোড়া চোখ আর...
আর ফাল্গুনে আসে যদি বরষা, তবু মনে ফাল্গুনই থাক...
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৭
এসএনএস