তাদের এহেন দশা দেখে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দেয় না। দু’একটা এনজিও ঋণ দিলেও তা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকে ফতুর বনে গেছেন।
কোন অফিসের কর্মকর্তা ভেবে কাজের ফাঁকে এভাবেই ক্ষোভ ঝাড়েন বৃদ্ধ সুকজান বিবি। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল এই বৃদ্ধার।
পরে অবশ্য সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে শান্ত হন তিনি। ‘আপনার সুখ-দুঃখের কথা মানুষকে জানানোর জন্যই আমরা এসেছি’—এভাবে বুঝিয়ে বলার এই প্রতিবেদক ও ফটো ক্যামেরাম্যানকে উদ্দেশ্য করে এবার বৃদ্ধা বলেন, ‘বাবারা, আমার কথায় মনে কষ্ট নিও না। ’
অনেক আগেই মারা গেছেন স্বামী। ছেলে-মেয়ে থেকেও নেই। বিয়ের পর সবাই আলাদা সংসার গড়েছেন। ওদের সংসারেও কমবেশি অভাব লেগেই আছে। মায়ের খোঁজখবর রাখার সময়টুকু নেই তাদের। তাই এ বয়সেও তাকে বাঁশের পণ্য বানিয়ে জীবন চালাতে হয়।
এটা কেবল সুকজান বিবির একার কথা নয়; বাঁশ-শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজারো নারী-পুরুষের মনের কথা বাঁশই তাদের জীবিকার আশ্রয়। বাঁশেই তাই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন তারা।
বগুড়ার ধুনট, শেরপুর, গাবতলী ও আদমদীঘি উপজেলার বাঁশশিল্পের জন্য খ্যাত বিভিন্ন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথার পর উঠে আসে এসব তথ্য।
ধুনট ও শেরপুর উপজেলার বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ বংশ পরম্পরায় এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
ধুনটের পাকুড়িহাটা, নলডাঙা, সোনাহাটা, বাঁশহাটা, কান্তনগর, শেরপুরের বিনোদপুর, কাশিয়াবালা, চকসাদী, মাঝিপাড়া, জোঁড়গাছা, তালপট্টি, কল্যাণী, সীমাবাড়ী, নাকুয়া, সুঘাট, গাবতলীর নিশোপাড়া ও আদমদীঘির সান্দিরা ‘বাঁশ শিল্পখ্যাত গ্রাম’ বলেই সর্বাধিক পরিচিত।
এসব গ্রামের কাছে যেতেই বাতাসে ভেসে আসে ঠুক-ঠাক শব্দ। কেউ দাঁ দিয়ে বাঁশ কাটছেন। আবার কেউবা ‘বেতি’ তৈরি করছেন রকমারি পণ্য তৈরির জন্য। গ্রামে গ্রামে বাঁশ নিয়ে চলছে নারী-পুরুষের কর্মযজ্ঞ। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা একাজটি করে থাকেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে তাদের এ কর্মযজ্ঞ। এভাবে একটি সময় দক্ষ হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় বাঁশ মানুষের নিত্যব্যবহার্য ও আকর্ষণীয় পণ্যের রূপ নেয়।
গুলভানু, সোনাভান, সখিনা, বিপ্লব, জেলহক, শফিকুল, বেল্লাল, কাশেম ---এরা এসব গ্রামের অসংখ্য বাঁশ-শিল্পীর কয়েকজন।
বাংলানিউজকে এরা জানালেন, এ পেশার সঙ্গে বংশ পরম্পরা ধরে জড়িত তারা। জীবিকা নির্বাহে এটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চাটাই, ডালা, ঝুড়ি, কড়পা, দারকি, ডোল, কুলা, চালুন, হোচা ছাড়াও বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে থাকেন তারা।
বুনোনের সিংহভাগ মূলত তারাই করেন। এছাড়া অন্যসব প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগাড় ও প্রস্তুতির কাজে যোগ দেন বাড়ির পুরুষরা। কিশোর-কিশোরিরাও এসব কাজে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়।
এদের অনেকে আবার স্কুলে লেখাপড়া করে। আবার স্কুলে যাওয়ার বয়স হলেও অর্থাভাবে অনেকে স্কুলে যেতে পারে না; গেলেও অনেকে পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারে না। অভাব-অনটনের কারণে ইচ্ছে থাকার পরও পরিবারের পক্ষে তাদের স্কুলে পড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সখেদে এভাবেই নিজেদের অক্ষমতার কথা জানালেন তারা।
বাঁশই বাঁশশিল্পের প্রধান উপকরণ। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাত মাপের একেকটি বাঁশ ৭৫ থেকে ১২০ টাকায় কিনতে হয় আজকাল।
আমির আলী, আবু হানিফ, রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বাঁশের তৈরি এসব সামগ্রী বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, শাহজাদপুর, ধুনট, শেরপুর, সোনাহাটা, হাসুখালি, গোঁসাইবাড়ী, এলাঙ্গা, তালগাছি, শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়াসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরের ব্যাপারিরা কিনে থাকেন। বিভিন্ন স্থানীয় হাট-বাজারে বাঁশের তৈরি এসব সামগ্রী বিক্রি করেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ৩০, ২০১৭
এমবিএইচ/জেএম