মুর্শিদাবাদের পর কলকাতা প্রথমে বাংলা-বিহার-ওড়িষ্যার রাজধানী ছিলো। এর পর কোম্পানি শাসন ও ব্রিটিশ রাজের শাসনের সময় কলকাতাকে পুরো ভারতবর্ষেরও রাজধানী করা হয়।
কাজেই ‘রাজধানী’র ঐতিহাসিক গন্তব্য তাই ঢাকা-মুর্শিদাবাদ-কলকাতা-দিল্লি। বর্তমানে ঢাকা, কলকাতা ও দিল্লি— তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ শহর। ঢাকা ও দিল্লি দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী। কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। শুধু মুর্শিদাবাদই হারিয়েছে তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব। আজকের মুর্শিদাবাদ শুধু অতীতের স্মৃতি ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। কিন্তু পুরো অবিভক্ত ভারতবর্ষের সবচেয়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহনকারী জায়গা হচ্ছে মুর্শিদাবাদ। কলকাতা, দিল্লি বিভিন্ন সময়ে রাজধানী হয়েছে মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা থেকেই। মুঘলরা রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লি আবার আগ্রা করেছে। ব্রিটিশরাও একই কাজ করেছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের পট পরিবর্তন ব্রিটিশদের ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক পথ প্রশস্ত করেছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো থেকে কলকাতা হয়েই মুর্শিদাবাদ যেতে হয়। মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছলাম। মুর্শিদাবাদ যাওয়ার জন্য পরের দিনের ট্রেন টিকেটের খোঁজে বের হয়ে গেলাম। কলকাতা থেকে একাধিক ট্রেন যায় মুর্শিদাবাদে। এর মধ্যে হাজারদুয়ারি, ভাগীরথী ও লালগোলা এক্সপ্রেস বেশ ভালো। সুবিধামতো সময়ের কোনো ট্রেন টিকেট না পাওয়ায় বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভারতে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ট্রেন। অধিকাংশ লোকই ট্রেনে যাতায়াত করে। ট্রেনে কয়েকবারই যাতায়াত করেছি। তাই বাসে ভারত ভ্রমণের একটি সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো বহুদিন থেকেই। ট্রেনের টিকেট না পাওয়ায় হয়তো সেটি পুরণ হয়ে গেলো।
বাসে যাওয়ার প্রধান কারণ, বাসে গেলে চারপাশটা অনেক ভালোভাবে দেখা যায়। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, কথাবার্তা হয়। দেশ, জনপদ ও মানুষকে সড়ক পথে যতোটা ভালোভাবে দেখা যায়, বোঝা যায়, রেলপথে ততোটা নয়। এছাড়া রেলপথ লোকালয় এড়িয়ে চলাচল করে। ফলে রেলে দেশের ভূ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য কিছুটা ভালোভাবে দেখা গেলেও মানুষ ও জনপদ রয়ে যায় দৃষ্টির অগোচরেই।
কলকাতা নিউমার্কেটের কাছেই ধর্মতলা বাসস্টান্ড। ওখান থেকেই মুর্শিদাবাদ, মালদা, ছত্তিশগড়হ অন্যান্য কয়েকটি জেলার বাস ছেড়ে যায়। বাসের অগ্রিম টিকেট পাওয়া যায় না। কিন্তু এক ঘণ্টা পরপরই ধর্মতলা থেকে বাস ছেড়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে।
পরদিন সকাল নয়টার মধ্যেই ধর্মতলা গিয়ে পৌঁছলাম। ধর্মতলা থেকে মুর্শিদাবাদে যাওয়ার কোনো এসি বাস নেই। তাই নন এসি বাসের টিকেট কেটেই বাসে গিয়ে বসলাম। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ২২৭ কিলোমিটার। কিন্তু টিকেটের দাম মাত্র ১০৯ টাকা। আমাদের বিআরটিসি বাসের মতোই এগুলো সরকারি বাস। তবে মান একটু ভালো, সেবাও ভালো।
কথামতো ঠিক দশটায় বাস ছেড়ে গেলো। এ বাসটি মালদা পর্যন্ত যাবে। মালদা মুর্শিদাবাদ থেকেও আরও তিন ঘন্টার পথ। নির্দিষ্ট স্থানে এ বাস থামে। যাত্রী ওঠা-নামার পরেই আবার বাস ছেড়ে যায়। কোথাও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে না। মাঝখানে শুধু দুপুরের খাবারের জন্য ৩০ মিনিটের একটি যাত্রাবিরতি রয়েছে।
কলকাতা শহর ছেড়ে বাস রানাঘাট, নদীয়া, বর্ধমান হয়ে এগিয়ে চললো মুর্শিদাবাদের দিকে।
অনেকটা পথ চলার পর বাস এসে থামলো কৃষ্ণনগর। এখানে ৩০ মিনিটের বিরতি দিয়ে আবার চলতে শুরু করে।
কৃষ্ণনগর আমাদের কাছে পরিচিত একটি নাম। পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলা অঞ্চলে সাতজন হিন্দু রাজা ছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাদের অন্যতম। এই কৃষ্ণনগরের রাজাই ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তার নামানুসারেই এ জায়গার নাম কৃষ্ণনগর।
কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চেয়ে যে নামটি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত তা হচ্ছে গোপাল ভাড়।
সুবে বাংলার আমলে মুর্শিদাবাদের নবাবের অধীনে একটি রাজ্য ছিলো এই কৃষ্ণনগর। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার অন্যতম রত্ন ছিলেন গোপাল ভাড়। গোপালভার তার রসবোধ ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রাজামশায়ের আসর জমিয়ে রাখতেন। তাই কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গোপাল ভাড় ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। পলাশীর সঙ্গে কৃষ্ণনগরের ছিলো একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক, যা পরবর্তী কোনো এক কিস্তিতে তুলে ধরতে চাই।
কৃষ্ণনগর কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের মাঝামাঝি পড়েছে। মুর্শিদাবাদ যেতে আরও প্রায় ১শ কিমি পথ বাকি। এখনও প্রায় ঘণ্টা তিনেক লাগবে।
কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ৫২ কিমি দূরত্ব পেরিয়ে বাস থামলো পলাশী। এই সেই পলাশী। হৃদয়ের পলাশী। শৈশব-কৈশোর থেকে যে নাম, যে শব্দ বাঙালির হৃদয়ের মাঝে স্থায়ী হয়ে লেখা হয়ে গেছে। যতোদিন বাংলা থাকবে, বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাস, ততোদিন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে অনুরণিত হবে পলাশী।
পলাশী আসতেই কল্পনায় ভেসে উঠলো ঐতিহাসিক পলাশী যুদ্ধের কথা। বাংলা-বিহার-ওড়িষ্যা তথা পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য এই ছোট্ট গ্রামটি থেকেই সেদিন অস্তমিত হয়েছিল। পাশেই ভাগীরথী নদী আর আম্র কানন, যেখানে সিরাজের খুনে লাল হয়েছিল ক্লাইভের খঞ্জর।
বাসের জানালার পাশে বসেই চোখ বুলিয়ে গেলাম পলাশীর ওপরে। অতি সাধারণ একটি মফস্বল বাসস্ট্যান্ড। ভেবেছিলাম এখানে পলাশী যুদ্ধের স্মারক হিসেবে অন্ত সিরাজের কোনো ফলক বা মূর্তিতো থাকবেই। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়লো না। অথচ আসতেই রাস্তার দুই পাশে নাম না জানা খ্যাত-অখ্যাত-বিখ্যাত কতোজনের মূর্তি-স্থাপত্য চোখে পড়লো। বুঝলাম, আমরা বাঙালি। ইতিহাস যতো আওড়াই, ততো মনে রাখি না। শুনেছি, পলাশী যুদ্ধ যেখানে হয়েছে সেখানে একটা ফলক স্থাপন করা হয়েছে বৈকি। তাও কয়েকজন বাংলাদেশিদের উদ্যোগের ফসল। তবুও কিছু একটা হয়েছে।
বিমর্ষ হয়ে তাকিয়ে রইলাম পলাশীর দিকে। পলাশীকে পেছনে ফেলে বাস এগিয়ে চললো মুর্শিদাবাদের দিকে। আরও ৫৩ কিমি পথ চলার পর ঘণ্টা দেড়েক পরে আমাদের গন্তব্য বহরমপুরে এসে পৌঁছলাম। বহরমপুর মুর্শিদাবাদ জেলার সদর। কলকাতা থেকে বহরমপুরে যেতে আমাদের প্রায় সাত ঘণ্টা লেগে গেলো। তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। তাই তাড়াতাড়ি করে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে লালবাগের পথ ধরলাম। লালবাগকে ঘিরেই মুর্শিদাবাদের দর্শনীয় স্থানগুলো বিস্তৃত। ভাগীরথীর তীরেই একটি হোটেলে বুকিং দেওয়া আছে। তাই লালবাগের পথ ধরলাম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ