ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের আগেই পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের আগমন ঘটে। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পর ইংরেজদের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
কাশিমবাজার রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কালকাপুরে ডাচ বণিকদের বসতি ছিলো। তারা হীরজহরতের ব্যবসা করতেন।
১৬৬৬ সালে কালকাপুরে অবস্থিত একটি ডাচ ফ্যাক্টরির কাজ শুরু হয়। আনুমানিক সাতশো থেকে আটশো লোক এখানে কাজ করতেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের এক ফরাসি বন্ধু ছিলেন যার নাম ছিলো জর্জ লুই ভার্নেট। তিনি ১৭৫৬ সালে এখানকার সর্বময় কর্তা হিসেবে আসেন। সেই ডাচ কারখানা অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে। তার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু সেখানে যারা কর্মসূত্রে কাশিমবাজারে এসেছেন, থেকেছেন— তাদের অনেকেই আবার এখানেই মৃত্যুবরণও করেছেন। যারা এখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের জন্য একটি পৃথক সমাধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু তারা ভিন্ন ধর্মালম্বী তাই তাদের জন্য এমন পৃথক সমাধিক্ষেত্র। মুর্শিদাবাদে এরকম আরও পৃথক সমাধিক্ষেত্র রয়েছে, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের নমুনা বহণ করে।
এখানে যেমন রয়েছে ডাচদের সমাধি, তেমনি রয়েছে মুসলমানদের, সুবেহবাংলার শাসক ও ইংরেজদের সমাধি। এইসব ছোট ছোট সমাধিক্ষেত্র ইতিহাসের বড়বড় নজির। প্রত্যেকটি সমাধিই ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়ের স্মারক। প্রত্যেকটি সমাধিক্ষেত্রে কানপেতে শোনা যায় ইতিহাসের মহাকালের শব্দগুঞ্জন, যা আমাদের নিয়ে যায় শত শত বছর আগে।
বকর্মানে ওই কারাখানার আর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, তবু ডাচ সিমেট্রিটি এখনও রয়ে গেছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে। এখানে ৪৩টি কবর রয়েছে। চারপাশে এখন বসতবাড়ি, বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কবরগুলো কোনোমতে মাটির উপরে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কয়েকটির উপরে ফলক রয়েছে যদিও, কিন্তু তার লেখা আজ আর বোঝার জো নেই।
এখানকার সমাধিগুগুলো ১৭২১ থেকে ১৭৯২ সালের মধ্যেই হয়েছে। সবচেয়ে পুরনো কবরটি হলো ড্যানিয়েল ভ্যান দার ম্যূল এর যিনি ১৭২১ সালে মারা যান। কিন্তু কোনটি তার সমাধি তা বোঝার উপায় নেই। কারণ, লেখা মুছে গেছে আরও আগেই। ‘সমাধি পরিচিতি’ থেকেই জানা গেলো পুরনো কবরটির তথ্য। ব্রিটিশ সিমেট্রিতেও একই অবস্থা। মানুষের নখরাঘাতে সমাধির নাম-পরিচয়ও মুছে গেছে, যেমনি গেছে কলমের আঘাতে ইতিহাস।
ডাচ সমাধিক্ষেত্র পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম আরও অনেকটা পথ। পথের পাশে চোখে পড়লো একটি কালী মন্দির। এখানে ভক্তদের ভিড়। মন্দিরের সামনেই সনাতন ধর্মালম্বীদের মহাদেব শিবের একটি মূর্তি।
মন্দিরের ভেতরে ভক্তরা কালীর ছিন্ন মস্তকের সামনে দাঁড়িয়ে বসে তার অনুকম্পা ভিক্ষা করছে। আর যার যা সামর্থ— পাঠা, মুরগি অথবা হাঁস নিয়ে এসেছে বলি দিতে। একটু আগেই একটি পাঠা বলি দেওয়া হয়েছে, এরই মধ্যে দেখা গেলো আরেকজন আরেকটি পাঠা নিয়ে হাজির।
মন্দিরের দেয়ালের উপরের চারপাশে রয়েছে সনাতন ধর্মের অন্যান্য দেব-দেবী ও মহাপুরুষের বিভিন্ন ভঙ্গির মূর্তি।
ভক্তরা সবাইকেই প্রণাম করে, খুশি করে নিজেরাও খুশি মনে বেরিয়ে যাচ্ছে। নামভজন আর কীর্তন চলছে সর্বদাই। শক্তির দেবী কালীর কাছে সনাতনী ধর্মালম্বীরা নিজ নিজ প্রার্থনায় মগ্ন। দেবীর আরাধনায় সঁপে দিচ্ছে নিজেকে।
লালগোলার অধিপতি রাজা শ্রীযুক্ত রাজা রাও যোগেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুরের ব্যয়ে এ মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ১৩২৩ সালে। তিনি ও তার পূর্বপুরুষ লালগোলার জমিদার ছিলেন। এই এলাকার শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে যোগেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ছিলো অনেক অবদান।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৭
এসএনএস
আগের পর্ব পড়ুন-
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন