কাসিম বাজার রেলস্টেশন থেকে পূর্ব দিকে মাইলখানেক এগোলে মূল সড়কের ডান পাশেই রয়েছে এই প্রাসাদ। এটি কাসিম বাজার ছোট রাজবাড়ি হিসেবেই পরিচিত।
অযোদ্ধারাম রায় ইংরেজদের পদানত নবাব নাজিমের কাছ থেকে ‘রায়’ উপাধি লাভ করেন।
অযোধ্যারামের পুত্র দীনবন্ধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাসিম বাজার রেশম-কুঠীর দেওয়ান ছিলেন। তিনি নবাব সরকারের কাছ থেকে খেলাত (রাজার দেওয়া সম্মানসূচক পোষাক) ও রৌপ্যমণ্ডিত ছড়ি ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিলেন।
সেইকালে রৌপ্যমণ্ডিত ছড়ি ব্যবহার করা সম্মানের বিষয় ছিল। দীনবন্ধুর পুত্র জগবন্ধু ও ব্রজমোহনও কাসিম বাজার রেশম-কুঠীর দেওয়ান ছিলেন। জগবন্ধু রায়কে কোম্পানি মেদিনীপুর কালেক্টরির দেওয়ানি দেয়। তিনি নিলামে পূর্ববঙ্গের রংপুর ও সরাইল পরগনায় জমিদারিও কিনেছিলেন।
জগবন্ধুর পরবর্তী উত্তরসূরি ছিলেন নৃসিংহ প্রসাদ, রাজকৃষ্ণ, অন্নপ্রসাদ ও এর পরে আশুতোষনাথ। আশুতোষ (১৮৭৪-১৯০৬) অল্প বয়সে মারা যাওয়ায় এবং তার উত্তরসূরী কমলারঞ্জন নাবালক হওয়ায় নিয়মানুযায়ী এ রাজবাড়ির দায়িত্ব পড়ে ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস’র হাতে। কমলারঞ্জন সাবালক হলে ১৯২৫ সালে জমিদারির দায়িত্ব পান। কমলারঞ্জনের বিভিন্ন জনহিতকর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৩৮ সালে ইংরেজরা তাকে ‘রাজা’ খেতাব দেয়।
রাজা কমলারঞ্জনের একমাত্র পুত্র প্রশান্তকুমার ও পৌত্র পল্লব (জন্ম- ১৯৬৪)। এই রাজপরিবারের বর্তমান সদস্যরা কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝেই মুর্শিদাবাদে এসে এই প্রাসাদেই থাকেন।
জমিদারি আজ আর নেই। তবে রাজবাড়িটি আজও তার স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও রাজবাড়ির আসবাবপত্র এবং অন্যান্য সামগ্রীর চেহারা সংস্কার করে অক্ষুন্ন রেখেছেন উত্তরসূরীরা। সমবেত পারিবারিক উদ্যোগে তারাই আজ কাসিম বাজার রাজবাড়ির সুদৃশ্য প্রাসাদটিকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে এনেছেন।
ইংরেজ আমলে অনেকেই ‘রাজা’ ‘মহারাজা’ ইত্যাদি খেতাব পেতেন। এসব উপাধি পেয়ে তারা নিজেদের ধন্য মনে করতেন। তাদের কেউ কেউ ইংরেজ কুঠিতে গোমস্তার কাজও করতেন। তবে তাদের অনেকেই আবার জনহিতকর কাজও করেছেন।
ক্লাইভ, হেস্টিংস বা উইলেসলির অনুকম্পায় সে কালের অনেক গোমস্তাও চাকর-বাকরও কালক্রমে বিত্তশালী রাজপুরুষরূপে পরিণত হয়েছেন।
কাসিম বাজারের এই ব্রাহ্মণ বংশের কৌলিক পদবি ছিল চট্টোপাধ্যায়। তবে এই পরিবার জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন বলেই জানা যায়। তারা প্রকৃত ব্রাহ্মণ ছিলেন।
এই প্রাসাদ বর্তমানে মূলত একটি জাদুঘর। এখানে আছে দুর্গা মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির ও লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। শ্রী কৃষ্ণের ‘ঝুলন যাত্রা’ উপলক্ষে এখানে প্রতিবছর রাসযাত্রা উদযাপিত হয়।
এখানকার মহামূল্যবান আসবাব ও তৈজসপত্রগুলো আজো অতীতের রাজকীয় স্মৃতি বহন করে। প্রাসাদটি বর্তমানে খালিই পড়ে থাকে। প্রাসাদের অধিকাংশ কক্ষেই বর্তমানে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীদের বাস। দোতলা এ প্রাসাদটির ওপরের তলা তালাবদ্ধই থাকে। রাজপরিবারের সদস্যরা এসে মাঝে মাঝে থাকেন। প্রাসাদটি ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতেই করা।
প্রাসাদের সঙ্গেই রয়েছে বিরাট পুকুর আর শানবাঁধানো ঘাট। বিভিন্ন ফুল-ফল গাছে সুশোভিত পুরো প্রাসাদ প্রাঙ্গণ। প্রাসাদ ভবনের ঠিক মাঝখানেই আছে একটি বিশাল মঞ্চ। প্রাসাদের চারপাশ থেকেই তা দেখা যায়। বোঝাই যায় নাচ-গানের আসর মাতিয়ে রাখতে এই প্রাসাদবাসীদের। এছাড়া প্রাসাদ ভবনের পাশেই আছে একটি কুস্তি খেলার মাঠ।
প্রাসাদের ভেতরে রাজপরিবারের সদস্যদের বংশলতিকা ও অনেকেরই ছবি আছে। এছাড়া আছে বহুমূল্যবান চিত্রকর্ম। রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্ম এর রক্ষণাবেক্ষণ করছেন বলে প্রাসাদটি এখনো বেশ চকচকেই আছে। মুর্শিদাবাদে এরকম ছোট-বড় রাজবাড়ি অনেক ছিল। বর্তমানে কয়েকটিমাত্র দাঁড়িয়ে আছে অতীতের স্মৃতি বহন করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ে ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৭
এইচএ/
আরও পড়ুন
** ১ম পর্ব: এক যে ছিলো মুর্শিদাবাদ
** ২য় পর্ব: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ
** ৩য় পর্ব: মানুষ যে হায় ভুলে গেছে চির মধুর ভালোবাসা
** ৪র্থ পর্ব: চার ভাইয়ের বাগান বিলাস ও একটি গুপ্তপথ
** ৫ম পর্ব: জগৎশেঠকে সপরিবারে হত্যা করা হয় যে প্রাসাদে
** ৬ষ্ঠ পর্ব: নুরলদীনের ‘জাগো বাহে’ শোনা যায় নসীপুর প্রাসাদে
** ৭ম পর্ব: কিরীটেশ্বরী মন্দির ও জগদ্বন্ধু সুন্দরের আশ্রম
** ৮ম পর্ব: মুর্শিদকুলি খাঁর কলিজাখেকো মেয়ের সমাধি!
** ৯ম পর্ব: হেস্টিংসের স্ত্রী, মেয়ের সমাধি ও একটি আর্মেনিয়ান চার্চ
** ১০ম পর্ব: মুজিবনগর ও পলাশী: বাংলার ইতিহাসের দুই আম্রকানন
** ১১তম পর্ব: ৩শ বছরের ডাচ সিমেট্রি ও যোগেন্দ্র নারায়ণের মন্দির
** ১২তম পর্ব: সতীদাহ ঘাটের পাতালেশ্বর মন্দির
** ১৩তম পর্ব : আশি টাকার গাড়ি ও সোনার রথ
** ১৪তম পর্ব : ষড়যন্ত্রের গ্রিনরুম ছিল কাসিম বাজার