১৬২৯ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত ৬ বৎসর সেবাস্টিন ম্যানরিক নামের এক পর্তুগিজ খ্রিস্টান পাদ্রি চট্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় অবস্থানকালে কয়েকটি স্থানীয় শহরের কথা উল্লেখ করেছেন তার ভ্রমণ কাহিনীতে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দেয়াঙ, যেখানকার শক্ত পর্তুগিজ ঘাঁটি ও গির্জায় তিনি অধিকাংশ সময় বসবাস করেছিলেন।
মূলত ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করলে ইংরেজ বণিক ও পাদ্রিদের প্রাধান্য বিস্তারের মুখে পর্তুগিজদের অবস্থান ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। তদুপরি দস্যুবৃত্তি ও লুটপাটের জন্য তারা স্থানীয় মানুষের বিরাগভাজন হওয়ায় ক্রমে ক্রমে বিতাড়িত হয়ে ভারতের অপর প্রান্তের পর্তুগিজ অধ্যুষিত গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি স্থানে চলে যায়। তবে এখনো চট্টগ্রামে পর্তুগিজ জাতির মিশ্রিত বংশধারা ও খ্রিস্ট ধর্মচর্চার ক্ষুদ্র একটি স্রোত লক্ষ্য করা যায়, যদিও সেটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়াঙ নগরে নয়, শহর ও আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে আসা-যাওয়ার পথে মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে ম্যানরিক যে রামু’র উল্লেখ করেছেন, তা দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি ক্ষুদ্র উপজেলা রূপে অদ্যাপি বিরাজমান। যদিও সেখানে পর্তুগিজ স্থাপনা, পর্তুগিজ জনজাতির স্মৃতি, শংকরায়ন বা সংস্কৃতির ঐতিহ্য বলতে বিশেষ কিছুই লক্ষ্যণীয় নয়, তথাপি এলাকাটির স্থানীয় মানুষের উপর আরাকানি-মগদের নানা প্রভাব নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ছাপ সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয়। কারণ রামু ছিল আরাকানি মগ শাসকদের দক্ষিণ চট্টগ্রামের কেন্দ্র। এখানে একজন গভর্নর বসতেন। এ এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ রাখাইন-মগ শাসনের স্মৃতিবাহী।
ম্যানরিক তৎকালের আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের রাজধানী ম্রোহং বা রোসাংগ-এর কথা বলেছেন। তিনি সেখানে রাজার সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলেন। স্থানটি আরাকানের মংডু বা অন্য কোনও শহরের নিকটবর্তী বলে প্রতীয়মান হয়, যা বর্তমানে সাবেক বার্মা বা আজকের মিয়ানমানের অধীনস্থ এবং এখানকার অধিবাসী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতিসত্তার মানুষ স্থানীয় সংখ্যাগুরু মগ ও বার্মিজদের চরম জাতিগত নিপীড়নের শিকার।
চট্টগ্রামে ‘অংগারকেল’ নামে আরেকটি শহরের কথা ম্যানরিক উল্লেখ করেছেন, যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়া শহর ‘অংগেরকেল’কে ম্যানরিক ভিলেজ, সিটি ও ব্যান্ডেল বা বন্দর নামে অভিহিত করেছেন তার ভ্রমণ গ্রন্থে। অতএব, তৎকালের প্রেক্ষাপটে ‘অংগারকেল’ একাধারে গ্রাম, শহর ও বন্দর ছিল, ম্যানরিক জনপদটিকে এমনভাবেই উপস্থাপন করছেন।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিম মনে করেন, ‘অংগারকেল আসলে ছিল একটি গ্রাম। পর্তুগিজদের গির্জা এবং বন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে কিছু লোকসমাগম হয়, তাই তিনি একে শহর বলেছেন। বন্দর বলার কারণ হলো, এখানে পর্তুগিজ নৌযান এসে নোঙর করতো। ’
‘ট্র্যাভেলস অব সেবাস্টিন ম্যানরিক’ গ্রন্থের অনুবাদ ও সম্পাদকগণ ‘অংগারকেল’ সম্পর্কে টীকা-ভাষ্য দিয়েছেন। জানিয়েছেন, এই স্থানটি আধুনিক মানচিত্রে পাওয়া যায় না। মনে হয়, জায়গাটি পর্তুগিজ বসতির মূলকেন্দ্র দেয়াঙ-এর তিন মাইল দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। সমুদ্রের শাখা নদী আকারে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করার সময় জায়গাটিকে দেয়াঙ থেকে পৃথক করেছে। মূলত এটি ছিল একটি জেলেপাড়া। তাকেই পর্তুগিজরা আবাসস্থলে পরিণত করে। সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী এখনও এমন দু’টি গ্রাম আছে, যার একটির নাম ‘হাঙ্গরখালি’, অপরটির নাম ‘হাড়িয়াখালি’। এগুলোও ‘অংগারকেল’-এর সঙ্গে অভিন্ন হতে পারে। হাড়িরা নিচ শ্রেণির মৎস্যজীবী এবং হাঙ্গর হলো উপকূলীয় কুমির, যাদেরকে ভিত্তি করে গ্রাম দুটির নামকরণ হয়েছে।
অনুবাদক ও সম্পাদকগণ ‘অংগারকেল’কে আধুনিক মানচিত্রে না পেয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় সাঙ্গু নদী তীরের ‘হাড়িয়াখালি’ ও ‘হাঙ্গরখালি’-এর সঙ্গে সাজুয্য সন্ধান করেছেন। কিন্তু তারা লক্ষ্য করেন নি যে, এই গ্রামগুলো নদীর তীরে অবস্থিত এবং সমুদ্র থেকে এদের দূরত্ব অনেক। অথচ ম্যানরিক স্থানটিকে স্পষ্টতই সমুদ্র তীরবর্তী বলেছেন। জানিয়েছেন যে, জায়গাটি দেয়াঙ-এর তিন মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। ফলে সাঙ্গু নদীর তীরে নয়, পর্তুগিজদের হারিয়ে যাওয়া শহর বা জনপদ ‘অংগারকেল’ সমুদ্র উপকূলের কোথাও অবস্থিত ছিল এবং জায়গাটি ছিল দেয়াঙ-এর বেশ কাছেই। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী প্রাচীন পর্তুগিজ শহর ‘অংগারকেল’ কোথায় হারিয়ে গেল, তা এক ঐতিহাসিক বিস্ময়!
ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
৫০০ বছর আগে পর্তুগিজরা এসেছিল চট্টগ্রামে
বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৭
এমপি/জেডএম