ঐশ্বর্যশালী ভারতের দিকে সম্মানের চোখে তাকিয়েছিল সারা বিশ্ব। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চিন্তাতেও তারা রেখেছিলেন সুদূরপ্রসারী ছাপ।
কিভাবে অতি দূরের একটি বহিরাগত জাতি সাড়ে তিন শ’ বছর অচেনা একটি জনপদ শাসন করতে পেরেছিলেন? শাসনকালে দেশটির প্রভুত উন্নতি ও অগ্রগতির ঘটিয়েছিলেন তারা। শাসক বা শোষক হিসাবে নয়, এদেশেরই একজন হয়ে উঠেছিলেন তারা। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি যেভাবে জাহাজ ভর্তি করে সম্পদ পাচার করেছে ইউরোপে, মুঘলরা এক কানা কড়িও এদেশ থেকে নেন নি। নিজের দেশেও আর ফিরে যান নি। পারস্য ও মধ্য এশিয়ার নানা ঐতিহ্য দিয়ে সাজিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে। ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল বিশ্বের ধনী, সমৃদ্ধ, সুশিক্ষিত, শিল্পময়, সাংস্কৃতিবান জনপদ। বিস্মৃত মুঘল শাসনের উজ্জ্বল অতীত এখনও বহু ক্ষেত্রে আলো ছড়াচ্ছে।
মুঘলরা ভারতের বুকে আরম্ভ করেছিলেন এক সমৃদ্ধ সভ্যতারও। আধুনিক নাগরিকতা, মননশীলতা, শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বোধ বলতে যা চিহ্নিত হয়, তার উদ্বোধন-পর্বটিও মুঘলদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। গোলাপ, গজল, কাসিদা আর দৃষ্টিনন্দন চিত্রকলা এবং বাহারি স্থাপত্যশৈলী যেমন মুঘলদের নিজস্ব অবদান, তেমনি রসনালোলুপ সুস্বাদু মুঘলাই খাবার আর পশমি-জরিদার পোশাক-পরিচ্ছদও মুঘলদের একান্ত কীর্তি। সব কিছু মিলিয়েই সামগ্রিকভাবে মুঘল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরম্পরা ও ঐতিহ্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষে সুসংবদ্ধ, উদার, বহুত্ববাদী সুশাসনের প্রবর্তন।
কিন্তু ইতিহাসের কী ঈঙ্গিত কে জানে, মধ্য এশিয়া থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতবর্ষে এসে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রথম শাসক এবং সর্বশেষ শাসকের কবর এই ভারতের বুকে হয় নি। প্রতিষ্ঠাতা বাবর সমাহিত রয়েছেন কাবুলে, আর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সুদূর রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুনে! তথাপি ইতিহাস-নির্মাণে, সভ্যতায়, সংস্কৃতিতে আর স্থাপত্য-কলায় মুঘল পরম্পরা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে রয়েছে।
মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন মুহম্মদ (১৪৮২-১৫৩০) বাবর তার পুত্র নাসিরউদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুনকে প্রদত্ত ওসিয়তনামায় বলেছিলেন: “হে পুত্র, হিন্দুস্তানের সাম্রাজ্য বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী/মতবাদের লোকের দ্বারা অধ্যুয়িত। তোমার কর্তব্য হচ্ছে সকল প্রকার অন্ধত্ব থেকে নিজের অন্তরকে মুক্ত করে প্রতিটি জাতির/শ্রেণীর/ধর্মের প্রতি সুবিচার করা। তাদের মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আর তোমার প্রতি বিশেষ অনুরোধ, তুমি হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের অন্তর ন্যায়বিচার দ্বারা জয় করবে। এই হচ্ছে উত্তম পন্থা। তুমি কোন জাতি বা ধর্মের মন্দির বা উপাসনালয়ের কখনও কোন ক্ষতি করবে না। ন্যায়বিচার করবে তাহলে প্রজাদের নিয়ে তুমি সুখে থাকবে। আর প্রজারাও তোমার শাসনে সুখে থাকবে। ইসলামের বিস্তারের শ্রেষ্ঠতম পন্থা হচ্ছে দয়ার তরবারি, অত্যাচারের তরবারি নয়। ”
১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাবর আগ্রায় স্বনির্মিত দৃষ্টিননন্দন উদ্যান-প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুত্র হুমায়ুনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং পুত্রের আরোগ্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার প্রয়াস শুধু পৌরাণিক-ধ্রুপদী মহাকাব্যেই পাওয়া সম্ভব, বাস্তবে এমন নজির কেবল বিরলই নয়, অভূতপূর্বও বটে। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি যখন মারা যান তখন তাঁর ২৬ বছরের বাদশাহি জীবন অতিবাহিত হয়েছে, যার মধ্যে শেষ ৪ বছর তিনি ছিলেন ভারতেশ্বর।
মুঘল সম্রাট বাবরের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী কাবুলের এক বৃক্ষচ্ছায়াতলে অবস্থিত পার্বত্য ঝর্ণার পাড়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সম্রাট বাবর নিজে কাবুলের পাহাড়-ঘেরা স্থানে উদ্যান নির্মাণ করে সেখানে তাঁর কবরের জন্যে একটি স্থান চিহ্নিত করেছিলেন এবং বাগানঘেরা স্থানটিকে তিনি ‘সবচেয়ে মনোরম জায়গা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। ইতিহাসের তথ্য মতে, বাবর বাগান খুবই ভালোবাসতেন। পুষ্পময় কাশ্মীর ছিল তাঁর অতি প্রিয় স্থান। কাশ্মীরকে বাবর বলতেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বাগিচা। ’ বাবরের উদ্যানপ্রীতি তাঁর অধঃস্থন সকল নৃপতিই বজায় রেখেছিলেন।
বিশাল ভারত জয় করে নিজেরই অলক্ষ্যে দীর্ঘকাল সেখানে শাসনের ভিত্তি রচনা করলেও বাবরের হৃদয়ময় ছিল মধ্য এশিয়ার স্মৃতি। সেই স্মৃতির টান তিনি কখনোই ভুলতে পারেন নি। ভুলতে পারেন নি মৃত্যুর কথাও। বিভারিজের অনুবাদে বাবরনামায় মৃত্যু বিষয়ক একটি কবিতায় ফুটে আছে তাঁর দার্শনিকতা:
এ দুনিয়ায় এসেছেন যিনি, তাঁকে মরতেই হবে
বেঁচে থাকবেন শুধু আল্লাহ, তিনি চিরঞ্জীবী।
জীবনের মেলায় যিনি প্রবেশ করেছেন,
তাঁকে শেষে মরণের পেয়ালা থেকে পানীয় গ্রহণ করতে হবেই।
যিনি জীবনের সরাইখানায় এসেছেন,
তাঁকে পরিণামে বিশ্বের দুর্গতির আলয় ত্যাগ করে যেতে হবেই।
পরবর্তী সম্রাট হুমায়ুন ছাড়াও বাবরের আঠারো জন সন্তান-সন্ততি ছিল, যদিও তিনি প্রিয় হুমায়ুনকেই নিজের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেছিলেন। বাবরের বয়স যখন সতের, তখন তাঁর প্রথমা স্ত্রী মির্জা সুলতান আহমদের কন্যা আয়েশা সুলতানা বেগমের গর্ভে একটি কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে। কিন্তু এক মাস পরেই এই শিশু মারা যায়। বাবরের স্ত্রী মহম বেগমের গর্ভে হুমায়ুন, বারবুল মির্জা, মেহেরজান বেগম, ঈশান বেগম ও ফারুক মির্জা জন্মলাভ করেন। স্ত্রী মাসুমা বেগমের গর্ভে একটি কন্যা সন্তান জন্মে। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে মায়ের মৃত্যু হলে মাতার স্মৃতি রক্ষার্থে মেয়ের নামও মাসুমা বেগম রাখা হয়। স্ত্রী গুলরুখ বেগমের গর্ভে কামরান মির্জা, আসকারী মির্জা, শাহরুখ মির্জা, সুলতান আহমদ মির্জা এবং গুল গাদার বেগম জন্মলাভ করেন। স্ত্রী দিলদার বেগমের গর্ভে গুলরং বেগম, গুলচেহারা বেগম, হিন্দাল মির্জা, গুলবদন বেগম (হুমায়ুন নামা-এর লেখক) এবং আলোয়ান মির্জা জন্মগ্রহণ করেন। বাবরের সকল সন্তানই কাবুলে জন্মে। শুধু মেহেরজান বেগম ও গুলরং বেগম জন্ম গ্রহণ করেন আফগানিস্তানের খোশত নামক স্থানে।
সম্রাট জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবর এবং তার মুঘল উত্তরাধিকারীরা ভারতবর্ষে বিশালত্বে ও চমৎকারিত্বে অদ্বিতীয় যে সাম্রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা ছিল তৎকালীন বিশ্বের জন্য অন্যতম বিস্ময়। ইউরোপের যে কোনও রাজ্যের চেয়ে এটি ছিল বৃহত্তম, লোকসংখ্যায় অনেক বেশি। আর ইউরোপের কোনও রাজ্যের রাজা মুঘলরাজের মতো এত বিপুল পরিমাণ রাজস্বও পেতেন না। মুঘল সম্রাটরা ভারতবর্ষে যে সব সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করেন, সেগুলোর সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব দর্শন করে সেইন্ট পিটার এর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পর্যটকও বিমুগ্ধ হতেন এবং বিস্ময় মেনে নিতেন। যারা ভার্সাই নগরের আড়ম্বরে অভ্যস্ত, তাদের চোখও দিল্লির সিংহাসনের জাঁকালো সৌন্দর্য এবং চারপাশের অমাত্য ও অনুচরবর্গের সংখ্যা দেখে ধাঁধিয়ে যেত। মুঘল সম্রাট কর্তৃক নিয়োজিত প্রাদেশিক সুবাদারদের প্রজার সংখ্যাও ছিল ফ্রান্সের রাজা কিংবা জার্মানির সম্রাটের চেয়ে অধিক। সুবাদার-শাসিত ভূখণ্ডের পরিধি এবং রাজস্বের পরিমাণ বিবেচনা করলে তাদের তুসকানির ডিউক এবং স্যাক্সনির ইলেক্টরের সমপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করতে হয়।
লক্ষ্যণীয়, ন্যায়বিচার দ্বারা মুঘলরা মানুষের অন্তর জয় করেছিলেন; পরমতের প্রতি সম্মান জানিয়ে মহান ঐতিহ্য স্থাপন করেছিলেন; দয়ার তরবারি দিয়ে নিজেদেরকে সম্প্রসারিত করেছিলেন। অন্যকে ক্ষুণ্ন ও অপদস্থ করে নয়, মর্যাদা দিয়েই নিজেদেরকে উচ্চ করেছিলেন মুঘলরা। প্রতিপক্ষের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে নিজের উচ্চতা সৃষ্টি করা কোনো প্রকৃত উচ্চতাই নয়-প্রহেলিকা মাত্র। নির্যাতন-নিপীড়নের স্তম্ভের ওপর দণ্ডায়মান উচ্চতা তাসের ঘর, যা সহসাই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
পরবর্তী-শাসকের উদ্দেশ্যে লেখা পরামর্শমূলক দিক-নিদেশনার মধ্যে হুমায়ুনের প্রতি বাবরের ওসিয়ত বা উপদেশসমূহ বিশ্বসেরা। বর্তমান কালের শাসকগণ উত্তরাধিকার সূত্রে ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে ভালো-মন্দ অনেক কিছু পেয়ে থাকেন বটে। কিন্তু ইতিবাচক ওসিয়তনামার মতো মহার্ঘ্য কিছু পেয়েছেন বলে কখনো জানা যায় না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন জ্ঞানগর্ভ উপদেশাবলি থেকে তাঁরা চরমভাবে বঞ্চিত। এই বঞ্চনার ভাগীদার আমাদেরকেও হতে হচ্ছে। কারণ, এ কথা পরম সত্য যে, শাসকের আলো সমাজ ও মানুষকে আলোকিত করে; শাসকের অন্ধকারও সবাইকে আচ্ছন্ন করে। বর্তমান বিশ্বের জনজীবনে চলছে সেই আলো-আঁধারের খেলা; ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতার দ্বৈরথ। খেলাটি বন্ধ হলে এবং পথটি ইতিবাচকতার দিকে উন্মুক্ত হলে মানুষ শুধু আকাশ বা বিশ্ব নয়-সকল কিছুকেই জয় করতে পারবে। নিজেকে এবং দেশকে সুসজ্জিত করতে পারবে।
গৌরবময় সুদীর্ঘকালে সমৃদ্ধ মুঘল শাসনের বর্ণিল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরম্পরার ইতিহাস শুধু গল্প ও কাহিনি জানার জন্য পাঠ করাই কর্তব্য নয়, ব্যক্তি ও সমাজের জন্য শিক্ষা আহরণ করাও দায়িত্ব।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গল্পকার-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৭
জেডএম/