রেনেলকে শুধু বাংলার নয়, বলা হয় ‘ভারতীয় ভূবিদ্যার জনক’। ভারত বা ব্রিটেন কেন, সারা ইউরোপেও তার তুল্য কেউ নেই।
রেনেল-এর পর ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’য় ইংল্যান্ড থেকে অনেকেই এসেছেন এবং কর্মজীবন শেষে তারা ফিরেও গেছেন। সে তালিকায় রয়েছেন বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বিদ্বান, অভিযাত্রী এবং আত্মভোলা-বিচিত্র চরিত্রের কিছু মানুষ। কিছু কিছু পাগলাটে, ক্ষেপাটে ও ছিটগ্রস্তকেও ভারতে-বাংলায় মানচিত্র বা এ সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত হতে দেখা গেছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এমনই একজন ফ্রান্সিস উইলফোর্ড। তিনি একজন বেপরোয়া জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক এবং একই সঙ্গে পশুচিকিৎসকও ছিলেন। তিনি ছিলেন অস্থির চরিত্রের মানুষ। একঘেঁয়ে লাগছে বলে লন্ডনের নিরাপদ ও স্থায়ী চাকরি ছেড়ে উত্তেজনার খোঁজে চলে এসেছিলেন সুদূর ভারতের অনিশ্চয়তায় ভরা রোমাঞ্চকর জীবনে।
এখানে এসে তিনি ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারর্স’-এ কাজ পান। সেই সূত্রে যুক্ত হন সার্ভের সঙ্গে। ১৭৮৮-১৭৯৪ সালের মধ্যে বেনারসের চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জরিপ করে মানচিত্র তৈরি করেন তিনি। একাজের পেছনে ছিল প্রচণ্ড উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ।
‘ট্রায়াঙ্গুলার সার্ভে’ বা ‘প্রিগোনেট্রিক্যাল সার্ভে’, বাংলায় যাকে বলা যায় ‘ত্রিকোণভিত্তিক জরিপ’, আঞ্চলিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয় ১৮১৪-২৩ সালের মধ্যে। আর পুরো কাজটি শেষ হতে হতে শতাব্দী-প্রায় গড়িয়ে যায়। সারা ভারত এর মাধ্যমে আবৃত হয় ত্রিভুজের রেখায়।
রেখায় রেখায় গড়ে ওঠে যেন বিশাল এক তোরণ, বিশ্বময় খ্যাতি যার ‘দ্য গ্রেট আর্চ’ বা ‘অতি-বৃহৎ খিলানাকৃতি তোরণ’ নামে। এ কৃতিত্ব অবশ্যই ঔপনিবেশক ইংরেজদের। যে তালিকায় এমন কয়েকজন রয়েছেন, যারা স্বকীয় কীর্তিতে ভাস্বর। প্রসঙ্গত উইলিয়াম ল্যাম্বটন এবং জর্জ এভারেস্ট-এর নাম করতেই হয়।
ল্যাম্বটন আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধে ইংল্যান্ডের তরফে লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন। এদেশে এসে তিনি যোগ দেন ‘আর্থার ওয়েলেসলি’-এর বাহিনীতে, যে বাহিনীর আর্থারই পরবর্তী ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’। ল্যাম্বটন ভারতের সব মানচিত্র পরখ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, গাণিতিক ও জরিপভিত্তিক পদ্ধতি ছাড়া এত বড় দেশের নির্ভুল, অখণ্ড-মানচিত্র প্রণয়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই পদ্ধতিগত দিক-নিদের্শনা এখানকার মানচিত্র রচনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও গতিবেগ নিয়ে আসে।
এরপরে আসে জর্জ এভারেস্ট-এর নাম। ছোটখাটো মানুষ ছিলেন তিনি, দেখলে মনে হয় ভীষণ ক্লান্ত । চোখ দুটি বসে গেছে এবং সব সময় তার গালে গালপাট্টা থাকতো। তিনি অত্যন্ত খিটখিটে মেজাজের এবং বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন। সহকর্মীরা বলেন, অতিশয় বদমেজাজি, যদিও রাধানাথ সিকদারকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন, স্নেহ করতেন, প্রতিভার তারিফ করতেন। বিশেষত তার গণিতের দক্ষতাকে মূল্য দিতেন, যার প্রমাণ পরে হিমালয়ের উচ্চতা পরিমাপের সময় কাজে লাগে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এহেন এভারেস্ট সাহেব কর্মযোগী মানুষ। ফাঁক ও ফাঁকি তার কাছে অচল। তিনি বিস্তারিত তথ্যই শুধু চান না, চান নির্ভুল তথ্যসম্বলিত বিবরণ। শীত থেকে বাঁচবার জন্য হিমালয়ের গাত্রে ৩৬০০ মিটার উপরের তাঁবুতে সব ধরনের ফাঁক-ফোকর নানাভাবে বন্ধ করে ভেতরে স্টোভ জ্বালিয়ে তিনি কাজ করেন।
সে আমলে জরিপ ও মানচিত্র প্রণয়নে যান্ত্রিক সহায়তা খুব একটা যে ছিল, তা নয়। উল¬ম্ব বা আনুভূমিক জরিপের জন্য সর্বত্র ব্যবহৃত হতো থিওডোলাইট নামক যন্ত্রটি। এই যন্ত্রের পাশাপাশি তিনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় কাজে লাগালেন হেলিওট্রোপ বা গোলাকার আয়না, যা একটা উঁচু দণ্ডের উপর বসিয়ে দিলে অনক দূরেও প্রতিফলিত আলোর সঙ্কেত পৌঁছায়।
১৮৪৩ সালে এভারেস্ট যখন অবসর নিয়ে ফিরে যান, তখন ত্রিকোণভিত্তিক সার্ভে কেবল হিমালয়ের নিম্নাঞ্চলে এসে পৌঁছিয়েছে। অনেক দূরে ‘পিক ফিফটিন’ বা ১৫ নম্বর শৃঙ্গ, যা তিব্বতিদের কাছে ‘চোমোলুঙ্গমা’ বা ‘বিশ্বের মাতা’ নামে পরিচিত ছিল, সেটাই ভবিষ্যতের ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হিসেবে বিশ্ব চিনতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, যার নামে এই সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম, সেই জর্জ এভারেস্ট অবসর গ্রহণের আগে শৃঙ্গটি নিজে দেখেছেন কি-না, সেটা নিয়ে রয়েছে বিরাট প্রশ্ন!
পূর্ববর্তী পর্ব
** গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাটলাস’, কাঁধে পৃথিবীর বোঝা
পরবর্তী পর্ব
** ‘আই হ্যাব ডিসকভারড দ্য হাইয়েস্ট মাউন্টেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’
বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৮
এমপি/জেএম