ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

অস্ত্র দিয়ে হয়নি যা, হলো তা বাঁশি দিয়ে

মো. রাজীব সরকার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৮
অস্ত্র দিয়ে হয়নি যা, হলো তা বাঁশি দিয়ে ছবি-বাংলানিউজ

গাজীপুর: যানজটের এক আতঙ্কের নাম গাজীপুর, বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। কিছুতেই যেনো মুক্তি  হচ্ছিল না, আশা ছিল সড়ক চারলেন হলে শান্তি আসবে। কিন্তু হলো উল্টো। চারলেন চালু হলেও যানজট পরিস্থিতির ঘটলো আরও অবনতি।

অবস্থাটা এমন ছিল, কেউ যাত্রা শুরুর কথাটা নিশ্চিত করে বলতে পারেন। কিন্তু কখন পৌঁছাবে তা বলতে পারেন না।

চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া বাইপাস, সাইনবোর্ড, বোর্ডবাজার, বড়বাড়ি, টঙ্গী স্টেশন রোড চেরাগআলী, টঙ্গী কলেজ গেট একেকটি পয়েন্ট ছিল দুর্ভোগের যজ্ঞনামা। পুলিশের রশি থেরাপি, বাঁশ থেরাপি, মাইকিং কোনোকিছুতেই কাজ হচ্ছিল না।
 
কিন্তু হঠাৎ যেনো এক তুড়ি মেরে সব দূর করে দিলেন একজন। সব মনোযোগ টেনে নিলেন নিজের কাছে। ঠিক হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো। আন্তরিকতা থাকলে যে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন।  
 
হাতে অস্ত্র ছাড়াও মানুষকে শৃঙ্খলায় আনা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। পুলিশ যে কাজটি অস্ত্রহাতে করতে অনেকখানি ব্যর্থ, ৩শ পোশাকধারী কর্মী বাঁশিতে ফুঁ দিয়েই সেই কাজটি করে দেখাচ্ছে।
 
ছবি-বাংলানিউজচারলেন সড়কটির অর্ধেকজুড়ে থাকতো ভাসমান হকার ও পার্কিংয়ের দখলে। বাঁকি দুই লেন কোথাও কোথাও সংকুচিত হয়ে মাত্র একটি লেনে যান চলাচল করতো। সেখানেও বাগড়া বসাতো যাত্রীবাহী বাসগুলো। রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করতো। আর তখনেই তৈরি হতো দুঃসহ যানজট। প্রত্যেকটি বাসেই ছিল যাত্রী তোলার এই অশুভ প্রতিযোগিতায় মত্ত। যার ফল ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট।
 
যে কাজটির জন্য ব্যাকুল ছিল জনগণ, সেই কাজটি খুব সহজে সমাধা করেছে জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন। যে পয়েন্টগুলোতে যানজট তৈরি হতো সেখানেই নামানো হলো ৩শ কর্মী। বিজয়ের মাসে মাঠে নামতেই বদলে যেতে থাকলো দৃশ্যপট। হকারের উৎপাত বিদায় হয়েছে অনেক আগেই। এখন চলছে যানবাহনে শৃঙ্খলা আনার কাজ।
 
রাস্তার উপর দাঁড়াতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে দিচ্ছে বাঁশিতে ফুঁ। আর তাদের এই তৎপরতায় বাসচালকরাও টাইট হতে বাধ্য হয়েছেন। এতেই দৃশ্যপট বদলে গেছে গাজীপুর এলাকার। যানবাহনে শৃঙ্খলার পাশাপাশি সিগন্যাল দিয়ে মানুষ পারাপার করে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে পুরো এলাকায়।
 
ছবি-বাংলানিউজসোমবার (৮ জানুয়ারি) দুপুরে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় কথা হয় মার্কেটিং কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগেও যানজটের কারণে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী যেতে সময় লাগতো আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা, বর্তমানে ৪০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টায়  টঙ্গী পৌঁছানো যায়।
 
এ উদ্যোগ যিনি নিয়েছে নিঃসন্দেহে তিনি একজন ভালো মনের মানুষ। তার জন্যই আজ লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ লাঘোব হয়েছে।
বাস চালক মোজাহিদ রহমান বাংলানিউজকে জানান, কিছু দিন আগে কোনো কারণ ছাড়াই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট লেগে থাকতো। এতে ঘণ্টা পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো।   ফলে গাড়ির অতিরিক্ত তেল-গ্যাস পুড়তো।
 
এই বাসচালক সরল স্বীকরোক্তিতে বলেন, মহাসড়কের মাঝখান থেকে যাত্রী ওঠা-নামা করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এতে পেছনের গাড়ি আটকা পড়ে যানজট সৃষ্টি হতো। একজনের দেখে অন্যজন নষ্ট হতো। ট্রাফিক সহকারীরা মহাসড়কের মাঝে কোনো গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করতে দেয় না। এতে যানজট অনেকাংশে কমে গেছে।
 
স্থানীয় বাসিন্দা জয়নুল আবেদীন জানান, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ের যানজট অনেক কমে গেছে। নেই আর গাড়ির দীর্ঘ লাইন।
 
রাজধানীর যানজট নিরসনে এমন উদ্যোগ ভালো ফলদায়ক হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
 
ছবি-বাংলানিউজট্রাফিক সহকারী মো. বিল্লাল হোসেন ও মোস্তাক আহাম্মেদ বলেন, কিছুদিন আগে বেকার ছিলাম। পরে জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের ট্রাফিক সহকারী হিসেবে চাকরি পাই। এটা শুধু চাকরি না, এখানে মানুষের সেবা করা যায়। অনেক বৃদ্ধ লোক আছেন যারা সড়ক পার হতে পারেন না। তাদের হাত ধরে সড়ক পার করে দেই। অনেকেই বাস স্টেশন চেনেন না। তাদের পথ দেখিয়ে দেই। মহাসড়কে অকারণে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেই না।
 
২০১৭ সালে ১০ মার্চ  জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠান করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর আলম। ৪শ  ৬জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তির মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ফাউন্ডেশন। এরমধ্যে ২শ জনকে এক লাখ টাকা করে, অন্যদের ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ, ৫০ জনকে ল্যাপটপ ও পাঁচজনকে মোটরসাইকেল দিয়ে অবাক করে দেয় স্থানীয়দের।
 
ছবি-বাংলানিউজএছাড়া ফাউন্ডেশন মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণীর দরিদ্র ও মেধাবীদের বৃত্তি, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের উচ্চশিক্ষায় বিশেষ সহায়তা ও মসজিদ-মাদরাসা, মন্দির ও গির্জায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে গাজীপুরের সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে।
 
ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে উঠে আসা এই তরুণ নেতা গাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আহ্বানে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচনে প্রার্থী হননি তাতে কি হয়েছে। গাজীপুরের দুর্ভোগ দেখে বসে থাকতে পারেননি। তাই নিজ খরচে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন ৩শ কর্মী। কর্মই তাকে মেয়র পদে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। স্বপ্ন দেখেন আধুনিক গাজীপুরের।
 
জাহাঙ্গীর আলমজাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, গাজীপুর একটি শিল্পাঞ্চল। এখানে যদি যানজট লেগে থাকে তাহলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে কীভাবে। আমি এই এলাকার সন্তান, তাই কাছ থেকে দেখেছি মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণা। বিবেকের তাড়না থেকে এই কাজ শুরু করেছি। টাকা যদি মানুষের কল্যাণে নাই লাগে তাহলে সে টাকা দিয়ে লাভ কি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৮
আরএস/এসআই/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।