এ যেন কামার, কুমার আর নানান কর্মজীবী মানুষগুলোর দরিদ্রতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর টুকরো টুকরো সংগ্রাম। পাশেই এ এলাকার সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে নীরবে বয়ে চলেছে শান্ত ‘বলভদ্র নদী’।
জীবিকা নির্বাহের দৈনিক প্রবাহে আপন মায়ের মতোই নানান উপকার সাধন করে চলেছে মোড়াকরিবাসীর প্রিয় এই ‘বলভদ্র’। হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার গ্রাম ‘মোড়াকরি’।
এ গ্রামেই সুধন রুদ্রপাল বড় সযতনে খোলশিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি অবদান রেখে চলেছেন ‘খোল’ নামক বাদ্যযন্ত্রটির সার্থক রূপকার হিসেবে।
রোববার (১৯ জুলাই) দুপুরটা ভরে উঠলো সুধন রুদ্র পালের বাদ্যসম্ভার নির্মাণের আলোচনায়। আকাশজুড়ে তখন মেঘ আর রৌদ্রের খেলা। অনাদিকাল ধরে সঙ্গীতে তবলার পাশাপাশি আরো একটি বাদ্যযন্ত্র সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে। এটি সুরের মুর্ছনায় মুগ্ধ করে রেখেছে আবহমান বাংলার চিরন্তন সংস্কৃতি ও ঐহিত্য। বাংলা লোকসংস্কৃতির কীর্ত্তন, বাউল, পল্লীগানসহ নানান ঘরানার সঙ্গীতে এই বাদ্যযন্ত্রটির উপকারিতা অস্বীকার্য।
ঐহিত্যবাহী এই বাদ্যযন্ত্রটির নাম ‘খোল’। আর এই বৃহত্তর সিলেটে খোলের মৃত্তিকাময় নির্মাতা ও সরবরাহকারী মোকাকরি গ্রামের মৃৎশিল্পী সুধন চন্দ্র রুদ্রপাল।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘শৈশবে বাবার কাছ থেকেই এই মাটির নানা প্রকারের কাজ শিখেছি। তবে বর্তমানে খোল-কেই প্রধান কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছি। এই কাজটি অপেক্ষাকৃত কঠিন। কেউ করতে চায় না। মাটির হাঁড়ি-পাতিল বাসন-কোসন যেভাবে সহজে তৈরি করা যায় এটি কিছুটা জটিল। আর আমার তৈরি খোল-এর চাহিদা রয়েছে বলেই এটিকে প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। ’
নির্মাণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে সুধন বলেন, আমি শুধু খোল-ই বানাই। ২০টা খোল তৈরি করতে ৩ দিন লাগে। এগুলো এঁটেল মাটি দিয়ে তৈরি করতে হয়। প্রতি পিস খোলের পাইকারি দাম ১৭০ টাকা। ঋষি সম্প্রদায়ের লোকেরা (চামড়ার কারিগড়) আমার কাছ থেকে এগুলো কিনে নিয়ে চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে খোল ব্যবহারকারীদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।
তিনি বলেন, আজমিরীগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, জলশুকা, ফান্দাউক, কিশোরগঞ্জের বাজিদপুরসহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে আমার তৈরি খোল বিক্রি হয়ে থাকে। খোলের পাশাপাশি সিঁদল মাছের বড় বড় মটকিও (হাঁড়ি) তৈরি করে থাকি।
ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে সুধন বলেন, আমরা সবাই যৌথ পরিবারেই আছি। বড়ভাই প্রহ্লাদ রুদ্রপাল রয়েছেন এই পারিবাবিক ব্যবসার সঙ্গে। বৈবাহিক জীবনে আমি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে কাজ করে বাজিদপুরে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। জীবনের আর্থিক সফলতার হিসাব টেনে সুধন বলেন, আসলে বলতে কষ্ট হলেও বলতে দ্বিধা নেই–মৃৎশিল্পের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আজ একেবারে নেই বললেই চলে। প্লাস্টিক, স্টিল এগুলো এসে একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছে আমাদের গ্রামবাংলা এই আবহমান ঐতিহ্যটিকে।
‘মাটির থালা-বাসন এখন আর কেউ সেভাবে ব্যবহার করেন না। আমি খোল-কে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে বেঁচে আছি। সব খরচ বাদে প্রতিমাসে আমার প্রায় দশ/বারো হাজার হাতে থাকে,’ যোগ করেন এই মৃৎশিল্পী।
আলাপচারিতায় জানালেন, এই শিল্পের বিষয়ে কোনো সহায়তা কিংবা সহযোগিতা মেলেনি তার। সরকার এ বিষয়ে সুনজর দিলে আমার মতো সারাদেশের মৃৎশিল্পীরা তাদের পেশাগত জীবনে সামান্য আশার আলো পেতেন বলে জানান মোড়াকড়ির সুধন চন্দ্র রুদ্রপাল।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৮
বিবিবি/এমএ