ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

নিরক্ষরদের বাতিঘর ‘সারপুকুর যুব ফোরাম’

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৮
নিরক্ষরদের বাতিঘর ‘সারপুকুর যুব ফোরাম’ সারপুকুর যুব ফোরাম। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: অক্ষরজ্ঞানহীন লোক শুধু নিজের নয়, সমাজের উন্নয়নে বড় বাধা। সমাজের উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য অজপাড়া গাঁয়ের নিরক্ষরদের অক্ষরজ্ঞান দানের পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস গড়তে ‘সারপুকুর যুব ফোরাম’-এর ব্যানারে ছুটে চলছে একদল তরুণ।

শুধু অক্ষরজ্ঞান দানই নয়, বঞ্চিত ও অবহেলিত জনগোষ্ঠিকে তাদের নাগরিক অধিকার পাইয়ে দিতেও কাজ করছে সংগঠনটি। এছাড়া বাল্যবিয়ে ও নারীদের উত্ত্যক্ত বন্ধেও সচেতনতামূলক মতবিনিময় সভা করে চলেছে এসব তরুণেরা।

এ যুব ফোরামের স্বপ্নদ্রষ্টা জামাল হোসেন লালমনিরহাট সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। তিনি আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের টিপের বাজার এলাকার আনসার সদস্য আব্দুস সাত্তারের ছেলে।

জামাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়ে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে ৭২টি ক্রেস্ট ও সনদ অর্জন করেছেন। এরমধ্যে ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলায় একক অভিনয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন, ২০১৫ সাল থেকে টানা চার বছর যুবছায় সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব পুরষ্কার, ২০১৭ সালের সেরাদের সেরা অ্যাওয়ার্ড, বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ বিএনসিসি, জেলা পর্যয়ে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক পুরষ্কার অন্যতম।

যুব ফোরামের স্বপ্নদ্রষ্টা জামাল হোসেন।  ছবি: বাংলানিউজজামাল বাংলানিউজকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই বই পড়া ও অন্যকে পড়ানোর আগ্রহ ছিলো। সেই থেকে পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। পাড়ার সমবয়সী ২০ জন বন্ধু মিলে স্কুলের টিফিনের জমানো টাকা দিয়ে বই সংগ্রহ করতে শুরু করি। এরপর এলাকাবাসীর সাহায্য নিয়ে সারপুকুর অর্ণিবান ফেডারেশনের জমি লিজ নিয়ে ২০১৪ সালে সারপুকুর যুব ফোরাম পাঠাগার গড়ে তোলা হয়।  

প্রথমে ৪৫টি বই নিয়ে পাঠাগারের যাত্রা শুরু করি। এখন বইয়ের সংখ্যা এক হাজার ২০০টি। নিয়মিত ৬০ ও সাধারণ পাঠক এক হাজারের উপরে। তারা চেয়ার বেঞ্চ না পেয়ে মাদুরে বসেই বই পড়েন। বিদ্যুৎ না থাকায় দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পাঠাগারটি খোলা রাখা হয়। সবশ্রেণি পেশার মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে একটি কেন্দ্রীয় পাঠাগার ও চারটি শাখা পাঠাগার রয়েছে। সপ্তাহে একদিন বইগুলো এক পাঠাগার থেকে অন্য পাঠাগারে চক্রাকারে সবার জন্য পৌঁছে দেওয়া হয়।

জামাল বলেন, আমাদের সংগঠনের সদস্যরা গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে নিরক্ষর নারী-পুরুষদের অক্ষরজ্ঞান দান করছে। গরীব ও দুস্থ পরিবারের ছেলে-মেয়ে যারা টাকার অভাবে প্রাইভেট পড়তে পারে না, তাদেরকে নিজের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়। এছাড়া সপ্তাহে তিনদিন পার্শ্ববর্তী মসজিদ ও মন্দিরের বারান্দায় স্কুলমুখী করতে ছোট শিশুদের বিশেষ ক্লাস নেওয়া হয়। বাম থেকে নিরক্ষর নারীদের অক্ষরজ্ঞান দান ও শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান।  ছবি: বাংলানিউজ

তিনি বলেন, সমাজের হরিজন ও দলিত শ্রেণির লোকেরা সবাই অক্ষরজ্ঞানহীন ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত। তাদের বাড়িতে গিয়ে বিকেলে ক্লাস নেওয়া হয়। এছাড়া তাদের ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে হরিজনদের জন্য প্রাপ্য অধিকার আদায় করে দেওয়া হয়েছে। এখন এ অঞ্চলের হরিজন ও দলিতরা জানে সমাজে তাদের কি কি অধিকার রয়েছে।

জামাল বলেন, হরিজন শ্রেণির লোকদের বাড়িতে পড়াতে যাওয়ার প্রথম দিকে গ্রামের লোকজন আমাকে ঘৃণা করতো। তাদের বাড়িতে পানি খাওয়ায় কেউ আমাকে খেতে দিতো না। এখন গ্রামের লোকজন বুঝতে শিখেছে হরিজনরাও মানুষ। তারাও সমাজের একটা অংশ।

সারপুকুর হরিদাস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণি বাংলানিউজকে জানান, নিরক্ষর ও অবহেলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জামালের আন্দোলন এ অজপাড়া গাঁয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। সমাজ আলোকিত করতে যুব ফোরাম বাতিঘর হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৮
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।