ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘মনহারা’র পুতুল নাচ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
‘মনহারা’র পুতুল নাচ পুতুল নাচ। ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া: পুতুল নাচ। গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য এটি। গানের তালে তালে কাহিনীর সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র ও সুরের মূর্ছনায় পুতুলের নাচ। গ্রামীণ জনপদে শিশু-কিশোর ও সর্বস্তরের মানুষের বিনোদনের একটি মাধ্যম। পুতুল খেলা শিশুদের কাছে উৎসবের মতো। 

মেয়ে পুতুলের সঙ্গে ছেলে পুতুলের বিয়ে-এ যেন গ্রাম বাংলার সাধারণ রূপ। আর তার সঙ্গে যদি সেই জড় পুতুল নাচে এবং কথা বলে তাহলে তো কথাই নেই।

ছোট থেকে বড় সবাই যেন তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে থাকে। বাংলার সংস্কৃতিতে বিনোদনের বড় মাধ্যম এটি। গ্রামীন মেলায় বসতো পুতুল নাচের আসর। রাত জেগে সেই পুতুল নাচ দেখতে ভিড় করতো গ্রামীন মানুষ।  

পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ।  

কাঠ অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরি করা হয়, সেটাতে রং-তুলির আঁচড় দিয়ে বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। পরে পুতুলের সঙ্গে সুতা বেঁধে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে তাদের নাচানো হয়। তবে কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।  

সাংস্কৃতির অলিখিত রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়ার জনপদে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে পুতুল নাচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। আজো মাঝে মধ্যে কোনো বাঙালি অনুষ্ঠানে দেখা মেলে এই ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ ও গানের আসর।  

কুষ্টিয়ার ‘মনহারা’ পুতুল নাচের যৌবনে দীপ্তমান কদর থাকলেও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে আজো বিশেষ কোনো আয়োজন ও গ্রামীন ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে টিপ টিপ প্রদীপের মতো বেঁচে আছে দেশের বিখ্যাত ‘মনহারা’ পুতুল নাচ।  

কুষ্টিয়ার এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচ দেখলে সত্যিই যে কারো মন হারিয়ে যায়। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের মৃত সলিম মালিথার ছেলে আব্দুস কুদ্দুস।  মনহারা পুতুল নাচের দল।  ছবি: বাংলানিউজজীবনের প্রায় সবটুকু সময় ব্যয় করেছেন এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচের সঙ্গে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচ দলের হাল ধরে রেখেছেন। আজো দেখিয়ে যাচ্ছেন সেই পুতুল নাচ।

আব্দুস কুদ্দুস বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৬৫ সাল তখন আমার বয়স ৯-১০। আমার বাবা খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন গান-বাজনা শেখানোর জন্য পুতুল নাচের দল ‘মনহারা’র শুকচান মাল নামের একজন ওস্তাদের কাছে নিয়ে যান। আমি তখন দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম। সেখানে মাস কয়েক পুতুল নাচের বিভিন্ন গান শিখি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে পুতুলের সঙ্গে নাচ-গান করতাম। এরই মধ্যে ওস্তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠি।  

প্রায় ১৬ বছর আমি পুতুল নাচের আসরে পুতুলের সঙ্গে মেয়ে সেজে গান করি। ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান করলে আমি ৫০-১০০ টাকা পেতাম।  

১৯৭২ সালে এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলটির দায়িত্ব পাই আমি। তখনো ওস্তাদ আমার সঙ্গে থাকতেন। তারপর ওস্তাদ শুকচান অসুস্থ হয়ে মারা যান। সে সময় দলে দুর্দিন নেমে আসে। আমাদের ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলে ছিলো ১৪ জন সদস্য। এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতো। বাকিরা বাদ্যযন্ত্র বাজাতো আর গান গাইতো।  

১৯৭৫ সালে আমি হারমোনিয়াম বাজানোর প্রশিক্ষণ নেই কুষ্টিয়া শিল্পকলা একাডেমি থেকে। তারপর ধীরে ধীরে দলের দুর্দিন প্রায় কাটিয়ে উঠি। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতাম। বেশ ভালোই চলছিলো আমাদের পুতুল নাচের দলটি। কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুল নাচ দেখিয়ে বেশ সুনাম অর্জন করি।  

তিনি আরো বলেন, কুষ্টিয়ার বাইরে চুয়াডাঙ্গায় ‘রাজকন্যা মনিক মালা’, ‘সীতার বনবাস, ‘রূপবান, ‘গরীবের ছেলে’, ‘গরীবের মেয়ে’, ‘হিংসার পরিনাম’ এবং মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, রাজশাহী, নড়াইল, ঢাকায় ‘প্রেম স্বার্থক’ ও ‘কালো গাজী’র পুতুল নাচের পালা করেছি।  

তারপরে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে ‘ঘুনাই সুন্দরী’ পালা করেছি। এছাড়াও আমি পুতুল নাচে সাপ, নৌকামাঝি, কুমার, মাছ, বাঘ, হুনুমান, হরিণ, ঘোড়া প্রভূতি বিষয় নিয়ে গ্রাম্য জীবন ভিত্তিক হাসি-ঠাট্টা ও তামাশামূলক গল্পে রচিত পুতুল নাচ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্যবার দেখিয়েছি।  

আব্দুস কুদ্দুস বলেন, আমার এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘সোনার যাদু’ ও ‘রূপবান’। এছাড়াও ‘সাগর ভাষা’, ‘ফেরারি সম্রাট, ‘নাচ মহল’, ‘ভিখারীর ছেলে’ অন্যতম পালা।  

তিনি আরো বলেন, ২০০৭ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে পুতুল নাচ প্রতিযোগিতায় আমি ও আমার দল অংশ নিই। সেখানে সারাদেশের ৪৮টি পুতুল নাচের দলের মধ্যে আমার দল প্রথম হয়। এছাড়াও ২০১৩ এবং ২০১৬ সালেও আমি পুরস্কার পাই।  

তিনি বলেন, পুতুল নাচ বাংলার মানুষের প্রাচীন একটি ঐতিহ্য। এই পুতুল তৈরি করতে যেমন টাকা প্রয়োজন তেমনি এই নাচ-গান পরিচালনার জন্যেও টাকার প্রয়োজন। তবে বর্তমানে অশ্লীল নাচ গানের কারণে এই গান করতে নানান বাধার সম্মুখিন হতে হয়।

প্রশাসন আমাদের প্রোগাম করার অনুমতি দেয় না। কারণ বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় পুতুল নাচের নামে বিভিন্ন ব্যক্তিরা অশ্লীল নাচ গান করায়। তবে আমাদের এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচ দেখতে এখনো অনেক মানুষ ভিড় করে। দলটিকে খুব কষ্টে টিকিয়ে রেখেছি। সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া আর কতদিন এভাবে টিকে থাকবে ঐতিহ্যবাহী এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচ। তবে আমি যতদিন বেঁচে আছি এই পুতুলের সঙ্গেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো। মানুষের মনে একটু আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করবো।

মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম জামাল আহমেদ বাংলানিউজকে জানান, মিরপুর উপজেলার ‘মনহারা’ পুতুল নাচ জেলার মধ্যে তথা সারাদেশেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আব্দুস কুদ্দুস এই দলটিকে ধরে রেখেছেন। বিভিন্ন স্থানের মানুষকে পুতুল নাচের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিনোদন দিচ্ছেন।  

তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের পরে সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে এ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো।  
 
বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৮
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।