ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

বঞ্চিত শিশুদের প্রাণের হাট আমাদের পাঠশালা

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৯
বঞ্চিত শিশুদের প্রাণের হাট আমাদের পাঠশালা আমাদের পাঠশালার শ্রেণি কক্ষ | ছবি: রাজীন চৌধুরী

ঢাকা: বাংলাদেশে সাধারণত স্কুলগুলোর সবচেয়ে গুরুগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করে প্রধান শিক্ষকের অফিস ও শিক্ষকদের কমনরুমের আশেপাশে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের কক্ষের সামনে মন খুলে কথা বলার পরিবেশও থাকে না শিক্ষার্থীদের জন্য। পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা ও পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এমন স্কুলের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য।

যদি এমন দেখা যায় যে, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকদের কমনরুমে শিক্ষার্থীদের অবাধ চলাফেরা। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার।

যদি শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বুঝে পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় তাহলে তা বাংলাদেশে আকাশকুসুম স্বপ্নই মনে হতে পারে।

স্বপ্ন নয়, ঠিক এমনই একটি স্কুলের উদাহরণ রয়েছে রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বরের ডি ব্লকে। স্কুলের পরিবেশ এরকমই হবে তার কথাই হয়তো সবসময় বলে থাকেন দেশের সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা।
আমাদের পাঠশালা ভবন | ছবি: রাজীন চৌধুরীআর্থ-সমাজিক বৈষম্য বিলোপে কাজ করা কয়েকজন তরুণ বঞ্চিত শিশুদের সঠিক মানসম্মত শিক্ষাদানের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যয়ন সম্পন্ন করা সেই তরুণরা ২০০৭ সালের স্বপ্নের সেই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেন। কর্মজীবী ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুলের নাম— আমাদের পাঠশালা।

২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আমাদের পাঠশালায় ভর্তি জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ীই তার শিক্ষাদান কার্যক্রম শুরু করে। স্বপ্নবাজ সেই তরুণদের পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ২০১০ সালে প্রথম প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও ২০১৩ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নেয়।  

দিনে দিনে আমাদের পাঠশালার কলেবর বেড়েছে কয়েকগুণ। সেই তরুণদের সঙ্গে সমাজের আরো বহু মানুষ যুক্ত হয়ে অলাভজনক স্কুলটিকে চালিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে বইপত্র, স্কুলড্রেস, টিফিন, চিকিৎসা সহায়তা দেওযাসহ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও স্কুল ভবনের ভাড়াসহ বিপুল খরচ সত্ত্বেও আমাদের পাঠশালা তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেয় নামমাত্র ৫০ টাকা! 

আমাদের পাঠশালায় গিয়ে প্রথমেই নজরে পড়ে আনন্দে ছুটে বেড়ানো, স্বতঃস্ফূর্ত অধ্যয়নরত এক ঝাঁক শিক্ষার্থী। স্কুলের নির্ধারিত সময় শেষে শিক্ষার্থীরা সেখানেই থাকছে সন্ধ্যা অবধি। বাড়ির চেয়ে তাদের স্কুলের ক্লাসরুমই বেশি প্রিয়।
আমাদের পাঠশালায় গানের ক্লাস | ছবি: রাজীন চৌধুরীক্লাসরুমগুলোতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা জটলা বেধে পড়াশোনায় মত্ত, কেউ কেউ আড্ডারত, কোথাও বসে গিটার-হারমোনিয়াম নিয়ে গানের রেওয়াজ করছে কেউ কউ। আবার কেউবা ছবি আঁকায় মন ডুবিয়েছে। ব্যবহার শেষে শিক্ষার্থীরাই গুছিয়ে রাখছে কম্পিউটার ল্যাব ও লাইব্রেরির বইপত্র, সরঞ্জামাদি।

আমাদের পাঠশালায় প্রবেশের পর এমন পরিবেশ দেখে অভিভূত হয়ে প্রধান শিক্ষক বা অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে পুরো ভবন ঘুরে কোথাও স্কুলের সেই ভাবগম্ভীর পরিবেশ না পেয়ে অবাক হতে হলো। প্রধান শিক্ষককে খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেলে হইহুল্লোরে মেতে থাকা একটি কক্ষ। যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যমণি হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন।

পাঠশালর এমন পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তোফাজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বঞ্চিত শিশুদের জন্য মানসম্মত মানবিক শিক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এরকমই  হওয়া উচিত। পাঠদানের ক্ষেত্রে আমরা খেয়াল করি শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পছন্দ করে, সেভাবে তাদের ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা তাদের আরো শেখাই যে— তুমি একা পারদর্শী হলেই চলবে না, তোমার পাশের বন্ধুটিকেও পারদর্শী হতে হবে। তাই আমাদের পাঠাশালায় যারা স্টুডেন্ট তারা তাদের বন্ধুদেরও শিক্ষক হয়ে ওঠে।
আমাদের পাঠশালার শ্রেণি কক্ষ | ছবি: রাজীন চৌধুরীপাঠশালার শিক্ষার্থীদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, কর্মজীবী শিশুরা যাদের পরিবারের অভিভাবকের পাশাপাশি আরো একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আবির্ভাব প্রয়োজন এমন শিশুরাও আমাদের শিক্ষার্থী। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জনমূলক কাজও করে। তাই আমাদের শিক্ষার্থীদেরও এমনভাবে গড়ে তুলতে হয় যেন তারা পড়ালেখার পাশাপাশি পরিবারকেও সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া স্কুলকেও শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হয়। যাতে তারাও পড়াশোনা ছেড়ে না যায়। এক্ষেত্রে আমরা সফল। তাই আমাদের স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তির চাপও অনেক বেড়ে গিয়েছে। এ বছর স্কুলে ২২০ জন ধারণ ক্ষমতার জায়গায় অভিভাবকদের চাপে ২৮৬ জন শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে ভর্তি করাতে হয়েছে। আমাদের এখানকার অনেক শিক্ষার্থীই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তাদের কয়েকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ পেয়েছে।

মূলত মিরপুরের সিরামিক ও বেগুনটিলা বস্তিসহ স্কুল ক্যাম্প, নতুন ক্যাম্প ও কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের সুবিধাবঞ্চিত ও কর্মজীবী শিশুরা আমাদের পাঠশালার শিক্ষার্থী।  

আমাদের পাঠশালার সাবেক শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের সহকারী হিসেবে কাজ করে, শিশুদের ক্লাস নেয়। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠশালায় পড়াশোনা শেষ করে সেখানকার শিক্ষকদেরই তত্ত্বাবধানে অন্যান্য স্কুলে ভর্তি হয়ে এসএসসি সম্পন্ন করে পাঠশালার শিক্ষার্থীরা। তেমনই একজন ইয়াসিন খান।

আমাদের পাঠাশালার  অভিজ্ঞতা ও পাঠদান সম্পর্কে ইয়াসিন বলে, আমি অন্যান্যদের চেয়ে তূলনামুলক ভালো রেজাল্ট করতাম। তাই নিজে পড়ে আবার সবাইকে পড়া বোঝাতাম। আমি চাইতাম আমরা সবাই মিলে যেন একসাথে বড় হতে পারি।
আমাদের পাঠশালার লাইব্রেরি | ছবি: রাজীন চৌধুরীআমাদের পাঠশালায় পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি নাচ, গান, চিত্রাঙ্কন, ভাস্কর্য, ফটোগ্রাফি ও কম্পিউটার শিক্ষার ক্লাসও হয়। এসব ক্লাস শনিবার হয়, এদিন সাধারণ পাঠ্যক্রমের ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা কিভাবে শিক্ষার্থীবান্ধব পাঠদান করবেন সে বিষয়ে নিয়মিত শিক্ষকদের কর্মসালাও অনুষ্ঠিত হয় বলে জানান আমাদের পাঠশালার শিক্ষিকা কাজী মাহমুদা আক্তার মুনা।

তিনি বলেন, পাঠদান প্রক্রিয়া যাতে নিরস না হয় সে জন্য আমরা অনেক সময় গল্প বলে, ছবি এঁকে, খেলার মাধ্যমে, ভিডিও দেখিয়েও শেখাই। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বুঝতে প্রয়োজনে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যবস্থা স্কুলে আছে। শিশুদের আমরা সৎ থাকা ও সত্য বলতে উৎসাহী করি। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বলে, আপনার এই আচরণটা আমার ভালো লাগছে না। আমরা তখন নিজেদের সংশোধন করি। প্রতি ৬ মাস পর পর শিক্ষার্থীরা চিঠি লিখে স্কুল সম্পর্কে মন্তব্য ও অভিযোগ থাকলে লিখে প্রধান শিক্ষকের কাছে জমা দেয়।  প্রধান শিক্ষক সেই অনুসারে যথার্থ ব্যবস্থাও নেন। স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় মার্কস কম ছাত্র যখন কাঁদে সঙ্গে শিক্ষকরাও কাঁদেন। শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা তো শিক্ষকেরই ব্যর্থতা।

মুনা বলেন, বর্তমানে স্কুলটির কার্যক্রম ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত হলেও এসব শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো পর্যন্ত সহযোগিতা করতে চাই। তবে এ জন্য আর্থিক সামর্থ্য বাড়া খুব জরুরি।  

আমাদের পাঠশালার কোষাধক্ষ্য রণজিত মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের  পাঠশালা বান্ধব পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় স্কুল চলছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অনেক চিকিৎসকরা সহায়তা করেন। শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ টাকা যে বেতন নির্ধারিত রয়েছে তা অনেক শিক্ষার্থী দিতেও পারে না অতিদরিদ্র হওয়ায়। আর তাদের ওই টাকা দিয়ে তো স্কুলও চলবে না। স্কুলে মাসে আমাদের মোট ব্যয় প্রায় ৪ লাখ টাকা, বার্ষিক খরচ ৪৫ লাখ টাকারও বেশি।

রণজিত মজুমদার বলেন, আমরা চাইছি আমাদের এখান থেকে পাস করে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যেতে। টাকার অভাবে আমাদের বেশিরভাগ মেধাবী শিক্ষার্থী বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারে না।  তাদের জন্য আমাদের হিসেব অনুসারে প্রতি মাসে জন প্রতি প্রায় তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। এসব শিক্ষার্থীদের পাশে আমরা ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারছি না। কেননা আমাদের ডোনারের সংখ্যা বা তাদের অনুদানের অঙ্ক বাড়েনি। এখন আমাদের যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ হয় তা দিয়ে পাঠশালার নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যদি কোনো হাসপাতাল বা ব্যক্তি এগিয়ে আসে তাহলেও আমাদের সুবিধা হতো।

আমাদের পাঠশালায় সহায়তার জন্য যোগাযোগ নম্বর: +৮৮০১৮১৬৩১২৬৪৮ এবং +৮৮০১৭২১৬২৩৬২৭।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৯     
এমএএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।