ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

টাইফুন, সাইক্লোন, হারিকেন- একই ঝড়কে এতো নামে ডাকা কেন?

ফিচার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৯
টাইফুন, সাইক্লোন, হারিকেন- একই ঝড়কে এতো নামে ডাকা কেন?

সারা বছরব্যাপী বিশ্বের কোথাও না কোথাও আঘাত হানতে থাকে সমুদ্রসৃষ্ট ভয়াবহ সব ঝড়। কিন্তু একই ঝড়কে কখনো ‘টাইফুন’, কখনো ‘সাইক্লোন’, কখনোবা ‘হারিকেন’ নামে ডাকা হয় কেন? এগুলোর মধ্যে আদৌ কী বিশেষ কোনো পার্থক্য আছে?

যেমন গত শনিবারই (১২ অক্টোবর) ঘণ্টায় ১৩৫ মেইল বেগে জাপানে আছড়ে পড়ে একটি ঘূর্ণিঝড়। এর কবল থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছাড়তে হয় লাখ লাখ মানুষকে।

এ ঝড়টিকে বলা হচ্ছে ‘টাইফুন হাগিবিস’। আবার গত মাসে বাহামা অঞ্চলে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়, কিন্তু সেটিকে ডাকা হয় ‘হারিকেন ডোরিয়ান’ নামে। অন্যদিকে চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টিকে বলা হয় ‘সাইক্লোন ফণী’। এই যে এতো এতো নামের বহর, এর কী আসলেই যথার্থ কোনো কারণ আছে? 

আবহাওয়াবিদদের ব্যাখ্যা অনুসারে- টাইফুন, সাইক্লোন, হারিকেন এগুলোর সবই সমুদ্রের উষ্ণ জলীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণায়মান ঝড়, যেগুলোর কেন্দ্রে থাকে খুবই নিম্ন বায়ুচাপ, আর বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ৭৪ মাইলেরও বেশি। তাহলে এদের নামকরণে এতো ভিন্নতা কেন? 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এ নিয়ে সবিস্তার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। চলুন পাঠক, জেনে নেওয়া যাক ‘টাইফুন’, ‘সাইক্লোন’ ও ‘হারিকেন’ নামকরণের প্রকৃত কারণ।  

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানাচ্ছে, ঝড়ের কারণ ও বৈশিষ্ট্য এক থাকা সত্ত্বেও মূলত অঞ্চল ও সময়কাল ভেদেই ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া আন্তর্জাতিক তারিখ রেখার ওপর ভিত্তি করেই এসব অঞ্চল ভাগ করা হয়েছে।  

অঞ্চলভেদে নামকরণ 
‘হারিকেন’ বলা হয় সেসব ঘূর্ণিঝড়কে, যেগুলো উৎপন্ন হয় উত্তর আটলান্টিক, উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত, ক্যারিবিয়ান সমুদ্র ও মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলে। অন্যদিকে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত সমুদ্র অঞ্চলঘেঁষা এশিয়ায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোকে বলা হয় ‘টাইফুন’।  

মজার ব্যাপার হলো কোনো ঘূর্ণিঝড় আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা অতিক্রম করে পূর্বে বা পশ্চিমে গেলে তার নামও বদলে যায়। যদি পূর্ব দিক থেকে কোনো ‘হারিকেন’ রেখা অতিক্রম করে পশ্চিমে চলে যায় সেক্ষেত্রে তাকে ‘টাইফুন’ বলে ডাকা হয়। আবার উল্টো ঘটনা ঘটলে ‘টাইফুন’ হয়ে যায় ‘হারিকেন’।  

আর দক্ষিণ গোলার্ধে, বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলীয় ভারত সাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত সমুদ্র অঞ্চল, বঙ্গোপসাগর অথবা আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোকে অভিহিত করা হয় ‘সাইক্লোন’ নামে।

সময়কাল অনুসারে নামকরণ
শুধু অঞ্চলেভেদেই নয়, বছরজুড়ে আঘাত হানার মৌসুম অনুসারেও তফাৎ আছে টাইফুন, সাইক্লোন ও হারিকেনে।  

আটলান্টিক অঞ্চলের হারিকেনগুলোর মৌসুম ধরা হয় সাধারণত জুন মাসের ১ তারিখ থেকে নভেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে হারিকনের মৌসুম এ সময়কালের সামান্য কিছুটা আগে। এদিকে টাইফুন সারা বছরব্যাপী যে কোনো সময় হতে পারে বলে জানানো হচ্ছে। যদিও বেশিরভাগই টাইফুনই সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে হয়ে থাকে।  

অন্যদিকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাইক্লোনের পরবর্তী মৌসুম নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। দক্ষিণ ভারত সাগর এলাকায় সাইক্লোনের মৌসুম ধরা হয় এ সময়কালের ২ সপ্তাহ আগে থেকে, কেবলমাত্র মরিশাস ও সিসিল দ্বীপাঞ্চলবাদে এ মৌসুমের শেষটাও একই সময়ে, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল। মরিশাস ও সিসিলতে মৌসুম শেষের সময় ধরা হয় মে মাসের ১৫ তারিখ। এছাড়া উত্তর ভারত সাগরে সাইক্লোনের নির্ধারিত বিশেষ কোনো সময় নেই। তারপরও এ এলাকায় সাধারণত মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে বেশি সাইক্লোনের আশঙ্কা থাকে।  

যেহেতু ঘূর্ণিঝড়গুলো সমুদ্রের বাষ্পীভূত জল থেকে শক্তি আহরণ করে, ফলে এগুলো স্থলে আঘাত হানার পর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। তারপরও যে নামেই ডাকা হোক, শক্তি নিঃশেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব ঝড় স্থলপথে অনেক দূর পর্যন্ত প্রবেশে সক্ষম। এতে করে ব্যাপক প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি, বৃষ্টিপাত ও বন্যার আশঙ্কা থাকে।  

প্রাবল্য অনুসারে বিভাজন  
সাফির-সিম্পসন স্কেলের ওপর ভিত্তি করে প্রাবল্য অনুসারে হারিকেনকে ১ থেকে ৫ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। ন্যাশনাল হারিকেন সেন্টার অনুসারে, ক্যাটাগরি ৩ বা এর চেয়ে ভয়াবহ হারিকেনে বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ন্যূনতম ১১১ মেইল। এ ধরনের হারিকেনে থাকে বিপুল জানমালের ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা। অস্ট্রেলিয়াও ১ থেকে ৫ ক্যাটাগরিতেই হারিকেনকে ভাগ করে থাকে।  

টাইফুন পর্যবেক্ষণ করে জাপানের আবহাওয়া সংস্থা। টাফুনকেও গতিবেগের ওপর ভিত্তি করে ‘টাইফুন’, ‘অতি শক্তিশালি টাইফুন’ ও ‘ভয়াবহ টাইফুন’, এ ৩ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়।  এছাড়া হাওয়াই দ্বীপের পার্ল হারবারে মার্কিন সামরিক কমান্ডের যৌথ টাইফুন সতর্কীকরণ কেন্দ্র শক্তিমত্তা অনুসারে টাইফুনকে ‘মৌসুমী নিম্নচাপ’ ‘মৌসুমী ঝড়’, ‘টাইফুন’ ও ‘সুপার টাইফুন’ নামে ভাগ করে সতর্কতা জানায়।  

এদিকে ভারত সাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনগুলোকে প্রাবাল্য অনুসারে দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- ‘অধিক শক্তিশালী মৌসুমী সাইক্লোন’ ও ‘সুপার সাইক্লোনিক ঝড়’।  

যে সব ঝড়ে বাতাসের গতিবেগ কম, অর্থাৎ ঘণ্টায় ৩৯ থেকে ৭৩ মাইলের মধ্যে সেগুলোকে বলা হয়- ‘মৌসুমি ঝড়’ বা ‘নিম্নচাপ’।  

ঘূর্ণিঝড়গুলোর সাধারণ ও বিশেষ নামকরণ 
ষোড়শ শতাব্দীতে স্প্যানিশ শব্দ ‘হুরাকান’ থেকে ইংরেজিতে ‘হারিকেন’ শব্দটির প্রচলন হয়। আর টাইফুন শব্দটি এসেছে আরবি ‘তাফা’ অথবা চীনা ‘তাইফেং’ কিংবা এ দুই শব্দ থেকেই। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতে অবস্থান করা এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা এ অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণে গ্রিক শব্দ থেকে ‘সাইক্লোন’ শব্দটি নেন। এর অর্থ ‘বৃত্তপথে ঘূর্ণায়মান’।   
তিন ক্যাটাগরির ঘূর্ণিঝড়ের বিশেষ নামকরণ যেমন- ‘ফণী’, ‘আইলা’ বা ‘ক্যাটরিনা’, এসব দেওয়ার কাজটি করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। বিশেষ অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই মূলত এসব নামকরণ করা হয়।  

ভয়াবহ হলেও মেরু অঞ্চলের দিকে উষ্ণ অঞ্চলের তাপ বয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে টাইফুন, সাইক্লোন, ও হারিকেনসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বিশ্বের সার্বিক আবহাওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।  

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৯ 
এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।