কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও দাবানলের লেলিহান শিখা থেকে মানুষ, বণ্যপ্রাণী আর প্রকৃতিকে বাঁচাতে নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে বীরের মতোন এগিয়ে আসেন অনেক মানুষ। পৃথিবীজোড়া তাদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়।
এই বিরল মানুষদেরই একজন ৬৬ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ার ড্যাগ শ্যুজ। সেই ১৩ বছর বয়স থেকে শুরু করে গত ৫৩ বছর ধরে দাবানলের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন এ নায়ক। তবু তিনি ক্লান্তিহীন। এই মুহূর্তেও অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়া দাবানল নিয়ন্ত্রণে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে। দেশের ছয় রাজ্যেই এর প্রভাব পড়লেও, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার নিউ সাউথ ওয়েলস আর ভিক্টোরিয়া। নিউ সাউথ ওয়েলসেরই দক্ষিণ উপকূলীয় এক গ্রামীণ অঞ্চল তোমেরং। এই তোমেরংয়েরই স্বেচ্ছাসেবী গ্রামীণ দমকল পরিষেবার ক্যাপ্টেন ড্যাগ শ্যুজ।
এ অঞ্চলে রীতিমতো এক নায়ক তিনি। দীর্ঘ জীবনে কতো শত মানুষকে যে দাবানলের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। নেতৃত্ব দিয়েছেন দাবানল নির্বাপণে ভয়ানক আর দুঃসাহসিক সব অভিযাত্রায়।
এই তো গত সপ্তাহেই দাবানল যখন অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, এর ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না, ঠিক সে সময়ই শ্যুজ আর তার অগ্নিনির্বাপক দল খুব দ্রুত এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাঁচিয়ে দেয় শত শত মানুষের এক লোকালয়।
ওইদিন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল আগুন। তার চেয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় শ্যুজকে। সেদিন কষ্টেসৃষ্টে অন্য এক জায়গা তারা জোগাড় করেন বুলডোজার। আর দারুণ কৌশলে তা কাজে লাগিয়ে থামিয়ে দেন আগুনের ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে ব্যাপক পরিসরে সেদিন কাজে লেগেছিল এই কৌশল।
এ অঞ্চলে এ ধরনের দুঃসাহসিক অভিযাত্রা সফল করার কেউ থাকলে, তিনি শ্যুজ। ৫৩ বছর আগে সাউথ ওয়েলসের এক গ্রামীণ ফায়ার সার্ভিসে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত হন। এ হলো সেই যুগ যখন ফায়ারট্রাক হিসেবে ব্যবহার করা হতো ল্যান্ডরোভার। ৫৩ বছর পর বর্তমানে তোমেরং ব্রিগেডের অধিনায়ক শ্যুজ। এ শাখার সদস্য সংখ্যা ১ হাজার।
শ্যুজ এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী দমকল বাহিনীর অংশ সাউথ ওয়েলসব্যাপী যার সদস্য সংখ্যা ৭২ হাজার। এটি সারা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী দমকল বাহিনী। সেপ্টেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়া দাবানল নিয়ন্ত্রণে অগ্রগণ্য এ বাহিনী।
অস্ট্রেলিয়ার চলমান এ দাবানলে এখন পর্যন্ত দমকল কর্মীসহ অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। ধংস হয়েছে দুই হাজারের বেশি ঘরবাড়ি। তাপমাত্রা আবারও বাড়ছে। আবারও দাবানলের নতুন করে জেগে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আগুনের সঙ্গে লড়াই করা যে কী ভয়ানক এক ব্যাপার, দীর্ঘ জীবনে সে ব্যাপারে বিস্তর অভিজ্ঞতা জমেছে শ্যুজের ভাণ্ডারে। শ্যুজ বলেন, আগুনের মস্তিষ্ক আছে। কাউকে পরাস্ত করতে তার আচরণ বুদ্ধিমান প্রাণীদের মতো!
‘আমি সারা জীবন তোমেরং অঞ্চলেই কাটিয়ে দিলাম। এ জীবনে অনেক অনেক দাবাবনলের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আগুনের নিজস্ব রীতি আছে। কখনো কখনো তো আমার এও মনে হয় যে, এর মস্তিষ্ক আছে। যখন আপনি ভাবছেন যে, এই তো ওকে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, ঠিক তখনই দেখবেন ও আবার পেছন দরজা দিয়ে এসে আপনাকে ছোবল মারছে। ’
দীর্ঘ জীবনব্যাপী এই আগ্রাসী আগুনের বিরুদ্ধেই লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে শ্যুজকে। এ মৌসুমে, নভেম্বরের ২৯ তারিখ থেকে তো প্রতিটা দিনই নিজের ব্যবসা লাটে তুলে তাকে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু, এ কাজের বিনিময়ে একটা পয়সাও পান না তিনি।
শ্যুজ হেসে বলেন, আমার ব্যবসা হলো আগুন জ্বালানোর জন্য মানুষের কাছে জ্বালানি কাঠ বিক্রি করা। আর এদিকে আমাকে আগুন নিভিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এ যেন এক পরিহাস!
মানবসেবায় অস্ট্রেলিয়ার মানুষের কাছে এক আদর্শ শ্যুজ। তিনি জানান, তার রক্তের মধ্যেই দাবানলের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারটা আছে।
‘আমরা দাবানলের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। দাবানল মোকাবিলায় স্থানীয় জ্ঞানই আমাদের সহায়। আমরা এখানকার সবকিছু জানি ও চিনি। আমার বাবাও তোমেরং স্বেচ্ছাসেবী ফায়ার ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ’
সবচেয়ে ভয়াবহ দাবানলের স্মৃতি জানতে চাইলে শ্যুজ বলেন, ২০০১ সালের দাবানল ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। সে বছর একেকটা ফায়ারবল (স্ফুলিঙ্গ) ছিল বাস্কেটবলের সমান। আমরা যখন ঘরবাড়ি বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম স্ফুলিঙ্গগুলো বৃষ্টির মতো আমাদের ওপর এসে পড়ছিল। নিজেদের বাড়ি হয়তো বিপদের মুখে, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবীরা অন্যদের ঘরবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করছিলাম। এক পর্যায়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখি আমার বাড়ি ও ব্যবসাস্থল আগুনের মুখে। কোনো রকম বাড়ি বাঁচাতে পারলেও, ভস্ম হয়ে যায় ব্যবসার জন্য মজুদ করা ৪ হাজার টন জ্বালানি কাঠ।
এবারের দাবানলও ভয়াবহ। এখন পর্যন্ত একে বাগে পাওয়া যাচ্ছে না। কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণে আসবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এ স্বেচ্ছাসেবক নেতা।
শ্যুজ বলেন, এখনও দাবানল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনতা না প্যারায়, বাইরের লোকরা হয়তো ভাবছে, অস্ট্রেলিয়ায় কিছু বোকা লোক বাস করে। কিন্তু, আমরা এমনই, এই আমাদের বাস্তবতা। অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে বসবাস করা দারুণ এক ব্যাপার, কিন্তু এটি নিজের মতো করেই বিপজ্জনক। আর সেই বিপদের অন্যতম হলো- দাবানল। দাবানল যে কোনো সময় যে কোনো দিক থেকে ছোবল বসাতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০২০
এইচজে