ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ক্যাম্পাসে প্রাণ খুলে হাসছে প্রকৃতি, যেন নিচ্ছে প্রতিশোধ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৫, ২০২০
ক্যাম্পাসে প্রাণ খুলে হাসছে প্রকৃতি, যেন নিচ্ছে প্রতিশোধ

ঢাকা: মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বদলে গেছে পুরো পৃথিবীর চিত্র। কোভিড-১৯ আতঙ্কের কারণে গাছপালা ও বহু প্রাণীর আশ্রয় ধ্বংস করে প্রকৃতিকে কোণঠাসা করেছে যে মানুষ- তারাই এখন অসহায়, নিরুপায় হয়ে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে ঘরে।
 

এই সুযোগে প্রকৃতি একদমই বসে নেই। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে, সাজিয়ে নিচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব।

এটাই যেন ওদের উপযুক্ত সময়। জনবহুল এলাকাগুলো ফাঁকা, যান চলাচল বন্ধ আর জনশূন্য উল্লেখযোগ্য সব স্থাপনা ও কেন্দ্রগুলো। বন্ধ হয়ে পড়ে আছে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। জনজীবন থমকে গেলেও কমেছে দূষণ, চকচকে তকতকে আলো। সৈকতে লাখ লাখ ডিম দিয়ে যাচ্ছে কচ্ছপ, হরিণ লোকালয়ে তার উদ্যম শরীর নাচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে নদী, বন, সাগর, বন্যপ্রাণী ও পাহাড়। প্রকৃতিতে ধরা দিয়েছে প্রাণবন্ততা।

...

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতিও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনোমুগ্ধকর লীলাভূমি ও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র নয়নাভিরাম আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর। ‘লকডাউনে’ প্রভাব পড়েছে এখানেও। ক্যাম্পাসজুড়ে কোথাও কোনো শিক্ষার্থী নেই, মানুষের হৈচৈ নেই, কোলাহল নেই, গাড়ির শব্দ নেই। ময়লা অবর্জনা নেই, রিক্ততা নেই। কেবল প্রকৃতির অন্তরঙ্গতা। ডালে ডালে সবুজের সমারোহ। সবুজ বনভূমির মাঝে লাল ইটের তৈরি ইমারত বৈচিত্রময় বিশ্ববিদ্যালয়কে করে তুলেছে আরও নান্দনিক।

...
কী এক নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশ। পাখ-পাখালির কণ্ঠে গেয়ে ওঠা মন মাতানো সব গান ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে চারদিক। মনে হয় কেউ বুঝি সবুজ রং ছিটিয়ে দিয়েছে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে। প্রকৃতি যেন তার রূপ, রস ও সৌন্দর্য বৃক্ষের শাখায় শাখায় ঢেলে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এখন বৃক্ষ ও ফুলের দখলে। যেন গাছপালা হাত বাড়িয়ে তার কোলের মধ্যে বসিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির অপরিমেয় সৌন্দর্যময় অকৃত্রিম মায়াময় রূপ বঞ্চিত করেনি কাউকে। ঘিরে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে শুরু করে লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, দিগন্ত জোড়া মাঠ, পায়ে হাঁটা পথ ও ভাস্কর্যসহ ৬৯৭ একরের ক্যাম্পাস। পাখির চোখে বিস্তৃত সবুজের মাঝে বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে স্থাপনাগুলো। আর তাই হয়তো পরিবেশ সচেতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতির রূপ ঘেরা সবুজ-শ্যামল বাংলাকে অবলোকন করে বলেছেন:

‘মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ
ধুলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ’

মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে প্রকৃতি নেই, সেখানে জীবনের সন্ধান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান জাতের গাছগাছালির সমারোহ এ ক্যাম্পাসকে দিয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শুধু একনিষ্ট প্রকৃতি প্রেমীর কাছে নয়, পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদেরও করেছে বিমোহিত। করোনার আতঙ্কে যখন ক্যাম্পাস হয়ে পড়েছে স্থবির, তখন উঁচু উঁচু হরিতকি গাছ, আম, জাম, নিম, শাল, দেবদারু, মধুকূপী ঘাস, বাঁশঝাড় তরতর করে লাফিয়ে বড় হচ্ছে। ইষ্টু-পুষ্ট হচ্ছে। কোনো মহামাহির আতঙ্ক নেই ওদের চোখে মুখে। ক্যম্পাসের বুকে কান পাতলেই এখন দিনভর এক প্রাণোচ্ছ্বাসের মর্মধ্বনি শোনা যায়।

...
অসংখ্য গুইসাপ, শঙ্গচূড়, বেজি, গঙ্গা ফড়িং, গিরগিটি, কাঠবিড়ালিসহ হরেক প্রজাতির প্রাণী নিজেদের সবটুকু মেলে ধরেছে ক্যাম্পাসের প্রকৃতিতে। এ যেন ওদের জীবনের যৌবনের জোয়ার। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বন একে দিচ্ছে টিয়া, ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখ-পাখালি। আজ ভালোবাসতে নেই বারণ। ওদের উদ্দীপনায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে অরণ্য।

ক্যম্পাসের জীববৈচিত্র্য বর্ণনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা মনে পড়ে গেলো-

পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’জনার মনে;
আকাশ ছড়িয়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে।

শহীদ মিনার।
সাদা মেঘের ওপর ভর করে নীল আকাশ ছড়িয়ে আছে আকাশে আকাশে। অথচ সংখ্যায় ভারী হচ্ছে লাশের সারি। সারা বিশ্ব মানুষের লাশের গন্ধে মৌ মৌ। অথচ প্রকৃতিতে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্নতা নেই। অনুশোচনা নেই।

বরং মানুষের অনুপস্থিতিতে প্রকৃতি যে কর্মচঞ্চলতায় পদার্পণ করেছে। তার সচিত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি। গাছে গাছে ফুল। ফুল যে কেবল বনের মধ্যেই তার শোভা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তা নয়, মানুষের মনের মধ্যেও সে শোভা ছড়িয়ে পড়ে বহু গুণে। নির্জন ক্যাম্পাসজুড়ে খইয়ের মতো মুখ তুলে ছড়িয়ে আছে কাঠগোলাপ।

...
‘কেয়া পাতার তরী ভাসায় কমল -ঝিলে তরু-লতার শাখা সাজায় হরিৎ নীলে। ছিটিয়ে মেঠো জল খেলে সে অবিরল কাজলা দীঘির জলে ঢেউ তোলে আনমনে ভাসায় পদ্ম-পাতার থালিকা। ’ কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটো যে কেউ আনমনে গুণগুণ করতে থাকবে এখন প্রাকৃতিক সমাচার দেখে। কেননা, ক্যম্পাসের লেকগুলোর স্বচ্ছ জলকণা চিকচিক করছে সূর্যকিরণে। লেকের পাড় জুড়ে ফুটে আছে বারো মাসি লাল শাপলা আর পদ্ম। কচ্ছপগুলোও মাথা বের করে বসে আছে জলে ভাসা ডালে। একজন আরেকজনের খোঁজ খবর নিচ্ছে। যেন সংসারের সমস্ত পাঠ চুকিয়ে তারা গল্পে মজেছে। সন্ধ্যা নামলেই শিয়াল, বাগডাশ, হুতুমপেঁচা, লক্ষ্মীপেঁচাসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর হাঁকডাক এক অন্যরকম মাদকতা সৃষ্টি করে।

...
এগুলো সাধারণত দেখা মেলা না কোহাহলপূর্ণ ক্যাম্পাসে। এই শুন্য ক্যাম্পাসজুড়ে কেবল ওদের আনাগোনা। দিনের বেলাতেও সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। এই বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী এভাবে কখনও দেখা যায়নি খোলা ক্যাম্পাসে। ওরা যেন বলছে, আমাদেরও আছে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার মানুষ তাদের দেয় না। তাই মানুষের গা ঢাকায়, ওরা গা মেলে ধরেছে। বৃক্ষ, পাতা, ফুল, ফল, মাটি, জল, জীবজন্তু, বাতাস একে অপরের সঙ্গে যে সেতুবন্ধন, তা মানুষের মধ্যে নেই। মানুষ একা, ওরা সবাই মিলে একটা জোট।

প্রকৃতি পৃথিবীর কাছে জীবন ও মৃত্যু, সভ্যতা ও সংকট, প্রলয় ও সৃষ্টি, পূর্ণতা ও নির্মূলের একাত্মতার প্রতীক। কিন্তু মানুষ এ সত্য ভুলে যায়। ভুলে যায় এই প্রকৃতি কেবল মানুষের একার নয়, ওরাও এর সমান অংশীদার। আর তাই প্রকৃতি যখন মানব সৃষ্ট অত্যাচারের সঙ্গে পেরে উঠে না। তখন অতিষ্ঠ প্রকৃতি মহামারির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে।

...
রবীন্দ্রনাথ তার ‘অরণ্যদেবতা’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, মানুষ তার নিজের কাজে ভীষণ হিংসুটে ও উদ্যত। মানুষ স্বভাবতই পেতে চায়। মানুষের এই অতিরিক্ত লোভই প্রকৃতির প্রধান শত্রু। একদিন অবশ্যই প্রকৃতি তার প্রতিক্রিয়া দেখাবে। প্রতিশোধের তীক্ষ্ম ফলা হয়ে বিদ্ধ করবে মানবসভ্যতাকে। কেননা, মানুষ তাদের স্বভাবগত স্বার্থন্ধতার কারণে মানবকেন্দ্রিক ব্যবহারই করে এসছে প্রকৃতিকে। রবি ঠাকুরের অনুমানই আজ সত্য নয় কি?

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৫, ২০২০
টিএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।