ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

গাছের বুকে পেরেক ঠুকে জমানো হয় সুগন্ধি

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
গাছের বুকে পেরেক ঠুকে জমানো হয় সুগন্ধি আগর গাছজুড়ে পেরেক। ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: নৈসর্গিক শোভায় মুখরিত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলা। এই উপজেলার প্রায় ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি আগরগাছের চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াকরণ হয় সুজানগর ইউনিয়নে।

এই ইউনিয়নের পাকা রাস্তাগুলো দিয়ে যাতায়াত করলেই নজর কাড়বে সারি সারি সবুজ আগরগাছ।

রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ওরা যেন অভিবাদন জানাচ্ছে আগন্তুকদের। তবে দেখতে গাছগুলো একই বয়স মনে হলেও সেগুলোর কিন্তু বয়স এক নয়। একেকটি বাগানের গাছের বয়স বিভিন্ন হয়। কোনোটার বয়স দুই বা তিন বছর। আবার কোনোটার বয়স পাঁচ থেকে সাত বছর হবে। কোনো কোনোটা বয়স আবার এই আগরগাছগুলোর চেয়েও বেশি।

তবে এই বাগানের গাছগুলো কিন্তু স্বাভাবিক নয়! অস্বাভাবিক গাছ। প্রায় প্রতিটি গাছের কাণ্ডে মারা হয়েছে অসংখ্য পেরেক। দেখলে মনে হবে, পেরেকের যন্ত্রণা নিয়ে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আগরগাছগুলো।  

একেকটি আগরগাছে প্রায় আট থেকে ১০ কেজি পেরেক গেঁথে দেওয়া হয়। তারপর তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে ওভাবে রেখে দেওয়া হয়। উন্নতমানের সুগন্ধি পেতে এটাই প্রক্রিয়া।  

সুজানগর এলাকায় অবস্থিত মেসার্স মরিয়ম আগর আতর ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সজীব আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, পেরেক বসানো যেসব গাছ সেগুলো কাণ্ড প্রাকৃতিকভাবে পোকা খায় না এবং কস (গাছের ভেতরের আতর অংশ) তৈরি হয় না। কস দুইভাবে হয়। একটা হলো গাছগুলো পোকা মাড়ক খাওয়ার কারণে আরেকটি হলো গাছের কাণ্ডে পেরেক বিঁধে দেওয়ার কারণে। এখন কোনো গাছ যদি পোকা না খায় তাহলে আতর (কস) হবে না, গাছটা অযথা কোনো কাজেই লাগবে না। সে কারণেই পেরেক বিঁধে দেওয়া হয়।  

বছর হিসাবে পেরেক মারার প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, পেরেক মেরে তিন বছর পর্যন্ত গাছগুলোকে রাখা হয়। তিন বছরের ওপরে রাখতে পারলে আরও ভালো। তারপর গাছ কেটে পেরেকগুলো তুলে ফেলা হয়। পেরেক মারা অংশগুলো কালো হয়ে যায়। ওগুলো থেকেই মূলত সুগন্ধি তৈরি করা হয়।

তিনি আরও বলেন, আগরগাছ লাগানোর পাঁচ থেকে ছয় বছর পর যদি দেখা যায়, প্রাকৃতিকভাবে পোকা খাচ্ছে না। তখন গাছে পেরেক মারতে হয়। আর যদি প্রাকৃতিকভাবে পোকা খায় তখন আর পেরেক মারতে হয় না। একজন আগর এক্সপার্টকে (বিশেষজ্ঞ) নিয়ে আগরগাছগুলোতে পরীক্ষা করাতে হয়। তিনি বুঝতে পারেন এগুলোর ভেতর প্রাকৃতিকভাবে আগর তৈরি হয়েছে কিনা? তবে এটা সত্যি যে, এখন শতকরা ৯৫ শতাংশ গাছেই প্রাকৃতিকভাবে আগর হয় না। বাধ্য হয়েই প্রতিটি গাছে ৮/১০ কেজি করে পেরেক বসাতে হয়। আমাদের মৌলভীবাজারের কিছু বিশেষ বিশেষ এলাকা রয়েছে। এখানে আবহাওয়া এবং মাটির কারণে আগরগাছে অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি ২/৩ বছরের মধ্যেই ভালো কস পাওয়া যায়।

শৌখিন আগর গাছ রোপণকারীদের উদ্দেশে ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সজীব আহমেদ বলেন, নার্সারি থেকে ভালো মানের আগরগাছ সাইজ অনুপাতে একশ ৫০ থেকে চারশ টাকা নেবে। বড় আকারের গাছ কিনলে ভালো হয়। লাগাতে হবে উঁচু জায়গায়। যেন কোনোভাবে গাছের গোড়ায় পানি জমে। সমান মাটি হতে হবে। লাল মাটি হলে তো কথাই নেই। এই গাছের জন্য টিলা এলাকা সবচেয়ে উত্তম। বসতবাড়ি বা বহুতল ভবনের ছাদেও আগরগাছ লাগানো যায়।

আমাদের সুজানগর ইউনিয়নের শতভাগ মানুষই আগর বা আতর ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এখানে ব্যবসা দুই ধরনের। কেউ কেউ আগরগাছ ও বনায়নের সঙ্গে জড়িত আছেন। আবার কেউ কেউ শুধু আতরের প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত। আমাদের এখানে প্রায় তিনশ ৬০টি পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে।  

বড়লেখা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর দাস বাংলানিউজকে বলেন, এই উপজেলায় বনবিভাগের মোট সংরক্ষিত জায়গার পরিমাণ সাত হাজার নয়শ ১৯ দশমিক ৫৫ একর। এছাড়া প্রায় তিন হাজার একর জমিতে সাধারণ জনগণ আগরগাছ লাগিয়েছে। তবে প্রায় ২শ হেক্টরের মত জমিতে আমরা আগর বাগান করেছি বিগত বছরগুলোতে। এগুলো এখনও কাটার উপযোগী হয়নি।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০
বিবিবি/এএটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।