সিলেট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন আরিয়ান হিজড়া (ছদ্মনাম)। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা তাকে ছেলে হিসেবে জানেন।
আরিয়ান জানান, বৈষম্য থেকে রেহাই পেতে পরিচয় গোপন করে চালিয়ে যাচ্ছেন পড়ালেখা। মেধাবী হওয়ার কারণে বাসায় গিয়ে পড়ানোর প্রস্তাব আসে হরহামেশাই। কিন্তু একপ্রকার বাধ্য হয়েই নাকচ করে দিতে হয়। এর কারণ ভয়। যদি জানতে পারে সে হিজড়া, তখন তো তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।
পথচলা কষ্টকর হলেও একেবারে একা নন আরিয়ান। পাচ্ছেন শিক্ষকদের সহযোগিতা। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্ন তার। রাষ্ট্রের পলিসি তৈরির পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যাওয়া তার লক্ষ্য। যেন বৃহত্তর পরিসর থেকে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে পারেন।
সম্প্রতি আরিয়ানের সঙ্গে আলাপ হয় বাংলানিউজের। এসময় উঠে আসে তার চলার পথে সংগ্রামের কথা।
আরিয়ান সিলেটে সগোত্রের মানুষ কেমন আছেন তার খোঁজ নেন। জানতে চান তারা কেমন আছেন। তাদের সম্পর্কে জানার পর আরিয়ান বলেন, দেশে বিসিএস ক্যাডারতো অনেক আছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে পলিসি পর্যায় থেকে হিজড়াদের জন্য কিছু করতে চাই।
ভালো নাচতে পারেন, গাইতেও পারেন আরিয়ান। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন পুরস্কারও।
ব্যবসায়ী বাবা ও গৃহিনী মা পরিবার ছাড়তে দেননি চাঁদনি হিজড়াকে (ছদ্মনাম)। লেখাপড়া করাচ্ছেন। স্কুলে গেলে তার বসা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হতো। ছেলে-মেয়েরা কারও সঙ্গে বসতে দিত না। মেয়েরা বলতো, ও তো ছেলে, ছেলেরা বলতো ও তো মেয়ে।
চাঁদনি তখন দুঃখ পেতেন, কাঁদতেনও। তিনি বলেন, এসব শোনার পর অনেক কান্নাকাটি করেছি। আল্লাহকে বলতাম, আমাকে পরিবর্তন করে দাও। নয়তো অনেক টাকা দাও, যাতে বৈষম্য দূর করে দিতে পারি। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে তিনি এখন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে এমবিএ শেষ অপেক্ষায়।
নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে চাঁদনি বলেন, আমি আইন নিয়ে পড়তে চাই। আইনজীবী হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মৌলিক অধিকার নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে কথা বলতে চাই। কারণ বাংলাদেশ চলে আইনের ওপর। আমি আমার জায়গা থেকে অধিকার নিয়ে উচ্চ আদালতেও কথা বলতে পারবো, আমার/আমাদের অধিকার কোথায়? আমাদের জায়গা থেকে লেখাপড়া করার, সুচিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ নেই। পরিবার থেকে বের করে দেওয়া হয়।
‘বাবা-মা আমার একটি সুন্দর নাম দিল। সে নামে কেউ ডাকে না, ডাকে হিজড়া বলে। যে কারণে স্কুল ও কলেজ জীবনে কারও বন্ধু হতে পারিনি। হিজড়ারা বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে নিগৃহীত হচ্ছে। পরিবার যদি বলতো, তুমি যেমন হও, সমাজ কি বললো, তাতে কি, তুমিতো আমাদের সন্তান। ’
চাঁদনি বলেন, ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন জনপ্রতিনিধি, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী হচ্ছেন। আর আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গের সুবিধাবঞ্চিত লোকজন ভিক্ষাবৃত্তি করছে। সরকার কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিলে এ ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে। কাজ থাকলে কেউ আর ভিক্ষাবৃত্তি করবে না, হাতে তালি বাজাবে না। অথচ সবার জন্য চাকরিতে কোটা আছে, কিন্তু আমাদের জন্য নেই। আমরা মনে হয় চিড়িয়াখানার জন্তু। আমরাতো কোনো মায়ের সন্তান। হিজড়ার পেট থেকেতো আর হিজড়া জন্মে না।
পদে পদে ভোগান্তির শিকার হন হিজড়ারা। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চাঁদনি বলেন, চিকিৎসার জন্য গেলে চিকিৎসক তাড়িয়ে দেয়। অথচ তারা সমাজকে ধারণা দিতে পারতো হরমোনজনিত কারণে এই সমস্যা। অথচ তারা উল্টো হেয় করে। যে কারণে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হিজড়ারা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স করছেন এলিজা হিজড়া (ছদ্মনাম)। নিজের খরচে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে চান তিনি। কিন্তু পড়ালেখা শেষ করে চাকরি দেবে কে? এই বিষয়টি নিয়েই চিন্তিত এলিজা।
তিনি বলেন, আমাদের পিছুটান একটাই। পেটে ভাত জুটানো। আর মাস গেলে বাসা ভাড়া দেওয়া। সরকারিভাবে অন্তত এই সুযোগ সুবিধা পেলে নিজেরা সুন্দরভাবে চলতে পারতাম, ভিক্ষা করতে হতো না। বৈষম্য দূর হলে হিজড়ারাও লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো। প্রয়োজন কেবল সহযোগিতার।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১
এনইউ/এইচএডি/