রাজশাহী: পদ্মা নদীর তীরে সবুজে ঘেরা নির্মল বায়ুর শহর রাজশাহী। দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় গাছপালা যেমন বেশি তেমনি রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাস।
শামুকখোল সাইকোনিডি গোত্রের বিশালাকার জলচর পাখি। বড়সড় গড়নের এ প্রজাতির পাখি ঝাঁক বেঁধে পদ্মার চরে ঘুরে বেড়ায় ও খাবার খায়। তবে সাইকোনিডিয়া গোত্রের কয়েক হাজার পাখি নিয়মিত আবাস হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। রাজশাহীতেও শামুকখোল প্রজাতির পাখিদের বসবাসের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। তবে শহরের বিভিন্ন জায়গায় পাখিদের বসবাস উপযোগী গাছপালা কেটে ফেলায় আশ্রয়হীন পড়ছে পাখিগুলো। মানুষের এমন নিষ্ঠুর আচরণের পরও এই প্রজাতির পাখিরা ঘুরে ফিরে নতুন আশ্রয় খুঁজে সংগ্রাম করেই রাজশাহীতে টিকে আছে।
পাখি গবেষকরা জানান, প্রায় আট বছর আগে শামুকখোল পাখি নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর এবং আশপাশের গাছগুলোতে বাসা বাঁধে। এখানে শামুকখোল প্রজাতির কয়েক হাজার পাখি নিরাপদেই ছিল। পরে ২০১৯ সালে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমির নির্মাণ কাজ শুরু হলে অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়। এতে পাখিগুলো আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
তবে খুব দ্রুতই নতুন আশ্রয় হিসেবে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের গাছগুলোকে খুঁজে নেয়। এখানে এসেও হারাতে হয় বাসস্থান। ২০২০ সালে হাসপাতালের গাছের ডালপালা কাটার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয়বারের মতো আশ্রয় হারিয়েও রাজশাহী ত্যাগ করেনি শামুকখোলের দল। তারা দ্রুতই হাসপাতালের পূর্ব পাশের রাস্তার ধারের গাছগুলোতে আশ্রয় নেয়। সম্প্রতি হাসপাতালের পুরনো সীমানা প্রাচীর ভেঙে নতুন করে নির্মাণের সময় প্রায় (পূর্ব পাশের) অর্ধশত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তাই পাখিরা এবার আশ্রয় নিয়েছে হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে। বার বার আশ্রয়হীন হওয়ার পরও পাখিগুলো শহর ছেড়ে যায়নি।
এখন পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকছে হাসপাতালের বহির্বিভাগ।
রামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে থাকা পাখিদের মোট সংখ্যার বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও গাছের ওপরে তাকালে শুধু পাখি আর পাখিই দেখা যায়। প্রতিদিন সকালে খাবার সংগ্রহে চলে যায় পাশেই থাকা পদ্মাপাড়ে। সকালে যেমন দল বেঁধে যায় ঠিক তেমনিই সন্ধ্যায় দল বেঁধে আপন নীড়ে ফিরে আসে তারা।
বর্তমানে রাজশাহী মহানগর ছাড়াও দুর্গাপুর ও বাঘা উপজেলায় শামুকখোল পাখির আবাস রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন আম গাছে বাসা বেঁধে বসবাস করছিলো পাখিরা। কিন্তু পাখির কারণে গাছে আম না ধরায় বাঘার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন বাগান মালিকরা। এ বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রচার হলে উচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে আসে। আদালত বাগান-মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে পাখিদের আবাস নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
পরবর্তীতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের বাগান মালিকদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ভাড়া হিসেবে চলতি বছরের ২১ মে পাঁচজন বাগান মালিক ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকার চেক পেয়েছেন।
রামেক হাসপাতালে গেলে কথা হয় করোনা টিকা নিতে আসা রহমত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শামুকখোলের ঝাঁক দেখলে অনেক ভালো লাগে। এক সঙ্গে এতগুলো পাখি খুব কম সময় দেখা যায়। পাখিরা সব একত্রে কত সুন্দরভাবে বসবাস করছে। পাখিদের ডাক শুনলে মনে হয় তারা নিজেরা গল্প করছে।
মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার অধিবাসী শামসুর রহমান চৌধুরী বলেন, গাছে গাছে পাখির বাসা এটি শহরের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন ভ্রমণের সময় এক সঙ্গে অনেকগুলো পাখির শব্দ শুনতে খুবই ভালো লাগে। শহরের মধ্যে সচরাচর এতগুলো পাখি এক সঙ্গে দেখা যায় না। এই পাখিদের আবাসস্থল সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
রাজশাহীর সেভ দ্য নেচার অ্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বিগত প্রায় আট বছর আগে শামুকখোল প্রজাতির পাখি রাজশাহী আসে। এরই মধ্যে গাছ ও ডালপালা কেটে ফেলায় তিনবার পাখিগুলো আশ্রয়হীন হয়েছে। আমরা প্রতিবারই প্রতিবাদ করেছি। তবুও এই প্রজাতির পাখিরা শহর ছেড়ে যায়নি। আমরা আশা করি পাখিগুলো এখন যেখানে আছে সেখানে থাকতে পারবে। কারণ, প্রকৃতি নিয়েই আমাদের বাঁচতে হয় এবং এরা প্রকৃতিরই অংশ।
তিনি আরও বলেন, কয়েকবার আশ্রয় হারিয়ে পাখিরা এখনো এই শহরে সংগ্রাম করে বসবাস করছে। কিন্তু নিয়মিত আশ্রয় হারাতে হলে তারা আর হয়তো এই শহরে আর থাকবে না। নতুন কোনো আশ্রয় খুঁজে নেবে। পাখিরা শহরের সৌন্দর্যকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় কখনোই নষ্ট করা উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন মিজানুর।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০২১
এসএস/আরআইএস