খুলনা: ভগ্ন প্রাসাদের মতো নির্জন কোলাহলমুক্ত বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই যে কারও গা ছমছম করবে। অনেকটা বন-জঙ্গল পরিপূর্ণ ভৌতিক পরিবেশ।
এই কুঠিবাড়িটিই খুলনা শাহরের প্রথম পাকা দালান বাড়ি। যেটি চার্লির নীলকুঠি নামে পরিচিত।
খুলনা রেলওয়ে হাসপাতাল সড়কে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডিসি) পরিত্যক্ত প্রাক্তন আঞ্চলিক কার্যালয় হিসাবে জরাজীর্ণ বাড়িটি আজো নগর পত্তনের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদিও বর্তমানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে বাড়িটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও দাঁড়িয়ে আছে আপন অস্তিত্ব জানান দিতে। বর্তমানে অযত্ন-অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। নির্জন এ বাড়িন আঙিনায় রয়েছে আম, নারিকেল, খেজুর, মেহগনি গাছ ও সবুজ ঘাসের গালিচা। দুটি সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে। দ্বিতীয়তলার কাঠের মেঝেটিও সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। তবে নিক্সন ও রেলওয়ে মার্কেটের ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হিসেবে পরিণত হয়েছে বাড়ির আঙ্গিনা। ফাঁকা বাড়িতে বখাটে, ভাসমান মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের নিরাপদ আড্ডা হতে দেখা গেছে।
২২১ বছরের বেশি পুরনো ঐতিহ্য আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে খুলনা মহনগরীর প্রথম দালানটি। বিআইডব্লিউটিসি আঞ্চলিক কার্যালয়ের যেখানে সাইন বোর্ড ছিলো সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাইন বোর্ড টানানো হয়েছে। যেখানে লেখা আছে ‘ইহা বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব সম্পত্তি বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, ১৭৯৫ সালে ইংরেজ নীলকর বন্ড যশোরের রূপদিয়াতে প্রথম নীলের কারখানা স্থাপন করেন। এই কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শুরু হয় নীল অত্যাচারের এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস। ১৮০১ সালে খুলনার দৌলতপুরে নীলকর এন্ডারসন প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এরপর শহরের কেন্দ্রস্থল রেলওয়ে হাসপাতাল রোডে নীলকুঠি স্থাপন করা হয়। এই কুঠিটি স্থাপন করেন নীলকর চার্লস। আর এই কুটিবাড়িটিই খুলনা শহরের প্রথম পাকা দালান বাড়ি।
প্রায় ৪৩ শতাংশ জমির ওপর দোতলা এই বাড়িটি অবস্থিত। ইট-বালি, চুন সুরকি, লোহার খাম্বা ও কাঠের পাটাতন দিয়ে নির্মিত। বাড়ির ছাঁদ নির্মাণ করা হয়েছে মাটির তৈরি টালি দিয়ে। টালির নিচেই রয়েছে হার্ডবোর্ড। বাংলো এই দোতলা বাড়িটির ওপরতলায় তিনটি ও নিচতলায় রয়েছে ৪টি কামরা । নিচ ও দোতলা কামরার সামনে আছে বড় খোলা বারান্দা। বারান্দায় কাঠ ও লোহার রেলিং। বাড়ির দোতলায় ওঠার জন্য পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রয়েছে দু’টি সিমেন্টের ঢালাই দেওয়া তৈরি সিঁড়ি। এই বাড়ির অনতি দূরেই ভৈরব নদ। নীলকর চার্লস তার বাড়ির পূর্ব পাশে ভৈরব নদের তীরে একটি বাজার গড়ে তোলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শহর হিসাবে খ্যাত হওয়ার আগে খুলনার পরিচিতি ছিল চার্লিরহাট বা সাহেবের হাটকে ঘিরে। নীল কুঠিয়াল চার্লস এ বাজার প্রতিষ্ঠা করার কারণে তার নামেই নামকরণ করা হয় চার্লিগঞ্জ বা সাহেবের হাট। বর্তমানে চার্লিগঞ্জ বা সাহেবের হাট বড় বাজার হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত। নীল চাষ এবং সাহেবের হাট চার্লি তার কুঠিবাড়ি থেকেই পরিচালনা করতেন। ঐ সময় এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অনেক নীলকুঠি ও নীলকরদের বাড়ি গড়ে ওঠে। এর মধ্যে চার্লির এ কুঠিবাড়িটিও ছিল অন্যতম। নীলকর চার্লস বা চোলেট সাহেবকে অনেকে চার্লি নামেও বলে থাকেন। তিনি ছিলেন খুলনার একজন নামকরা নীল কুঠিয়াল। অনেকের মতে তিনি ছিলেন স্থানীয় লবণ এজেন্সির প্রধান ইওয়ার্টের সহযোগী। অন্যান্য নীলকুঠির মতো চার্লির এ পাকা দালান বাড়িটিও ছিল নীলকরদের কেন্দ্র।
১৮৮৪ সালে কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। তখন থেকে চার্লির বাড়িটি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানির (আইজিএনআরএসএন কোং) কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হতো। সে সময় ঐ কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে চার্লির বাড়িতে বসে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়ার্ডসন, নওয়াব হামিদ ইসমাইল, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী (পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী), খাজা গোলাম সরওয়ার ও এসআর দোহার মতো ব্যক্তিরা। ভারত বিভক্তির পর নেভিগেশন ও রেলওয়েকে পৃথক করা হলে বাড়িটি নেভিগেশনের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে চার্লির বাড়িটিকে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয়। চার্লির বাড়িটিকে ২০০১ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে খুলনা সিটি কর্পোরেশন।
রেলওয়ে হাসপাতাল রোডের বাসিন্দা সুকুর আলী জানান, বাড়িটিতে বিআইডব্লিউটিসির একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পরিবার-পরিজনসহ বসবাস করতেন। কিন্তু গত কয়েকমাস আগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ইজারা দেওয়া সম্পত্তি বুঝে নেওয়ায় বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। এ কারণে তারা বাড়িটি থেকে চলে যান। বর্তমানে ফাঁকা বাড়িটিকে মাদক সেবী ও বখাটেদের আড্ডার নিরাপদ স্থান হয়েছে।
খুলনার সচেতন মহল মনে করছেন, কালের সাক্ষী পুরাতন এই বাড়িটি পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠতে পারে একটি দর্শনীয় স্থান।
খুলনার ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক এএইচএম জামাল উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, চার্লির নীলকুঠির প্রতি আমার দরদ রয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ বাড়ির ওপর কাজ করেছি। সংস্কার আর সুষ্ঠু সংরক্ষণের অভাবে প্রাচীন এ বাড়িটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি মর্মাহত কারণ বাড়িটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সামনে কিছু দোকান পাট হয়ে যাওয়ায় বাড়িটি আড়াল পড়ে গেছে। এখন আর রাস্তা থেকে দেখা যায় না। আমি আশংকা করছি ইট পাথর যা আছে তাও হয়তো খুলে নিয়ে যাবে।
তিনি বাড়িটি সংরক্ষণে স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
খুলনা রেলওয়ের কানুনগো মো. মনোয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিআইডব্লিউটিসিকে বাড়িটি লিজ দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ দিন লাইসেন্স ফি বকেয়া থাকায় ওটা আমরা দখলে নিয়ে সিলগালা করে দিয়েছি। সিলগালা করার পর প্রকৌশল বিভাগের ওখানে বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়ার কথা। স্যাংশন হয়ে গেছে। ঠিকাদারও নিয়োগ হয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। পরে কাজ বন্ধ হয়েছে কী কারণে তা জানি না।
বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২১
এমআরএম/এজে