ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

বাংলাদেশের রক্ষক সুন্দরবন, সুন্দরবনের রক্ষক বাঘ

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০২ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
বাংলাদেশের রক্ষক সুন্দরবন, সুন্দরবনের রক্ষক বাঘ সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার। ছবি: আদনান আজাদ

মৌলভীবাজার: সৌর্যবীর্যের প্রতীক বাঘ। বাংলার বাঘ (Bangle Tiger), আমাদের বাঘ।

তাই জাতীয় পশু হিসেবে এ প্রাণীটি তার শ্রেষ্ঠত্ব ধারন করে আছে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের এই প্রাণীটি বিপন্ন। এদের টিকে থাকার নানা উপকরণের ক্ষতিসাধণ করে বাঘের অস্তিত্বকে ফেলে দেওয়া হয়েছে মারাত্মক হুমকির মাঝে।

‘বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষার দায়িত্ব সবার’ এ স্লোগানটি নিয়ে শুক্রবার (২৯ জুলাই) বন অধিদপ্তরের নানা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে পালিত হয়েছে বিশ্ব বাঘ দিবস।

বাংলার বাঘের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে স্বনামধন্য বন্যপ্রাণী গবেষক ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী আদনান আজাদ বলেন, ‘যখন আপনি চিন্তা করবেন যে আমি বনে হরিণ শিকার করবো, অতিরিক্ত মাছ আহরণ করবো কিংবা গাছ কাটবো এগুলো সবই বাঘের ঝুঁকির অন্যতম কারণ। আমি কিন্তু বাঘ মারছি না, তবে বাঘ না মারলেও বাঘের সঙ্গে রিলেটেড (সংযুক্ত) বা বাঘ যেসব ওপর নির্ভরশীল সেগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া মানেই কিন্তু বাংলার বাঘকে পুরোপরি ধ্বংস করে দেওয়া। ’ 

‘হরিণ তো বাঘের খাবার। আমরা যদি হরিণ অবৈধভাবে মেরে খেয়ে ফেরি তাহলে বাঘ খাবে কী? আপনি যখন সুন্দরবনের নদীর থেকে মাছ শিকার করবেন তখন দুই থেকে আড়াই বছর বয়সী মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া বাঘগুলো কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কেননা ওই বাঘগুলো তখন নদীর পড়ে বসে মাছ শিকার করে খেয়ে বেঁচে থাকে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে এই বাঘগুলো শিকার করতে পারেন না, ওরা যখন খুব ক্ষুধার্ত থাকে তখনই নদীর পরে বসে মাছ শিকার করে। সুতরাং মাছও বাঘের খাবার। যদি বাঘকে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে বাঘের সঙ্গে রিলেটেড সবগুলো বিষয়ের প্রতি যত্নবান হয়ে এগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। ’
 
বাঘের সঙ্গে রিলেটেড মূল বিষয়গুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে শুধু প্ল্যান (পরিকল্পনা) করলে বাঘ রক্ষা হবে না। বনের অন্যান্য প্রাণীগুলোকেও সংরক্ষণ করতে হবে যে প্রাণীগুলো বাঘের আহার হিসেবে ব্যবহার হয়। সর্বপরিই প্রাকৃতিক বনকে পুরোমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে, তবেই বাঘ সংরক্ষিত হবে বলে জানান তিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে আদনান বলেন, বাংলাদেশ ব-দ্বীপ এবং সমুদ্রতীরবর্তী একটি দেশ এখানে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়। সিডর, আইলার মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ গেছে। সমুদ্র থেকে উৎপত্তি হয়ে যখন বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন বাংলার বাঘের বসবাসভূমি সুন্দরবনের কোটি কোটি গাছগুলোই ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে থেকে এই ঝড়টাকে প্রতিহত করে। এজন্য আমাদের দেশ এখনো নিরাপদে রয়েছে। নয়তো কবেই বাংলাদেশ এরূপ শক্তিশালী প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে যেতো। এই সুন্দরবনটা টিকে আছে শুধুমাত্র বাঘের কারণে। বনে বাঘ না থাকলে মানুষ কবেই সুন্দরবনের ছোট-বড় সবগাছ কেটে লুট করে নিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস করে দিতো এবং বসতবাড়ি বানিয়ে ফেলতো। কারণ সবাই বাঘকে মারাত্মকভাবে ভয় পায়: ‘ওখানে বাঘ আছে, ওখানে যাওয়া যাবে না’।

‘বাংলাদেশের ফুসফুস’র কথা উল্লেখ করে আদনান আজাদ বলেন, বাঘ হচ্ছে সেই উপকারী প্রাণী বাংলাদেশকে যে বন রক্ষা করে সেই বনকেই বাঘ রক্ষা করে। অ্যামাজন বন যদি হয় বিশ্বের ফুসফুস, তাহলে সুন্দরবনকে বাংলাদেশে ফুসফুস বলা ভুল হবে না। বাংলাদেশের ফুসফুসের রক্ষক হচ্ছে বাঘ। সেই বিবেচনায় কিন্তু বাঘ আমাদের রক্ষক। এই বাঘকে যে কোনো মূল্যেই টিকে রাখতে হবে। শুধু বাঘই নয়, আমাদের প্রাকৃতিক বনের যতো প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে তাদের প্রতি চোরাশিকারিদের গোপন তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। এজন্য বন বিভাগকে দ্রুত তৎপর হতে হবে।

‘বাঘ নিয়ে তার ব্যক্তিগত মতামত’ প্রসঙ্গে বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান বাংলানিউজকে বলেন, ২৯ জুলাই বাঘ দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে নানান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বাণী দিয়েছেন, পরিবেশমন্ত্রী এসেছেন, ঢাকায় অনেক বড় শোভাযাত্রা হয়েছে, বাঘের বড় ব্যানার তৈরি করা হবে, ঢাকার কোনো একটা সম্মেলন কেন্দ্রের সেমিনারে দেশের বিশেষজ্ঞরা, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং সাধারণ লোকজন বাঘ নিয়ে মতবিনিময় দিয়েছেন। কিন্তু আমি বলতে চাই, ঢাকা শহরে এ রকম সেমিনার করে আমরা যদি জানলাম যে, বাঘ আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এরূপ কার্যক্রমগুলো ঢাকা শহরে না করে যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে করা যেতো অর্থাৎ সুন্দরবনের আশেপাশে যে গ্রামগুলো আছে, যারা বনজীবী তাদেরকে নিয়ে যদি করা যেতো তাহলে এই বাঘ রক্ষা বা বাঘের বিষয়ে সচেতনতা আরও ৫০ শতাংশ বাড়তো। ওইসব এলাকার লোকজন তো বাঘের আশেপাশে থাকে, বাঘ তো তাদের গ্রামে এসে মানুষকে আক্রমণ করলে বা গৃহপালিত পশুকে আক্রমণ করলে তখন তো ওই মানুষগুলোই বাঘকে আক্রমণ করে মেরে ফেলছে। অথবা বনে গিয়ে বাঘের সাথে তাদের এক প্রকারের কনফ্লিট (দ্বন্দ্ব) হচ্ছে। বাঘ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশের জন্য এবং তাদের জন্য এটা তো বনজীবীরা জানেন না। তো, ঢাকা শহরের লোকজন এগুলো জেনে করবে কী?সুন্দরবনঘেঁষা যে গ্রামগুলো রয়েছে, সেসব গ্রামের যেসব বাসিন্দা আসে তাদের মাঝে যদি এই বাঘ রক্ষায় সচেতনা শীর্ষক প্রোগ্রামগুলো যদি করা হয় তাহলেই কাজ হতো। ঢাকা বাঘ নিয়ে যে সভা-সেমিনার-প্রোগ্রামে যে টাকা খরচ করা হয় তার চার ভাগের এক ভাগ টাকা খরচ করে যদি সুন্দরবনের আশেপাশের লোকালয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম করা হতো তবে বাঘ রক্ষায় আমরা আরও ৫০ শতাংশ এগিয়ে যেতাম।

রাজধানীতে বসে ঢোল-পিটিয়ে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা হবে না বলে জানান বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।