ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ঐতিহ্যের ধারক পাথরের জাদুঘর

সোহাগ হায়দার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২
ঐতিহ্যের ধারক পাথরের জাদুঘর

পঞ্চগড়: সময়টি ১৯৯৭ সাল। পঞ্চগড়ের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, প্রাগৈতিহাসিক কালের নমুনা সংগ্রহ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক এশিয়া মহাদেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর স্থাপন করা হয় পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে।

আর সেটির নামকরণ করা হয় রকস্ মিউজিয়াম।  দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাদুঘরটি।

এক সময় ছোট একটি টিনসেট ঘরে পাথরের জাদুঘর বা মিউজিয়ামটি গড়ে তোলা হলেও বর্তমানে মিউজিয়ামটিকে একটি দালানে রেখে উন্মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীন স্থানে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালু, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালু, কাঁচবালু, খনিজবালু, সাদা মাটি, তরঙ্গায়িত চেপ্টা পাথর, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শিলা- এ রকমের হরেক পাথরের সমারোহ। এসব পাথরের আকৃতিও ভিন্ন। কোনোটি গোল, কোনোটি লম্বা আবার কোনোটি চেপ্টা। এগুলোর অনেকগুলোতে আবার বিভিন্ন ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা। সঙ্গে মিউজিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করলে খালি চোখে পড়ে নদী থেকে পাওয়া দু’টি বিশালাকার নৌকা। যেগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামের মাঝখানে।

আর উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইড পাথর, গাছ থেকে রূপান্তিত হওয়া পাথর। যা প্রতিনিয়ত পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে।  

এদিকে ভিন্ন এ জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখে অনেকটাই জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন শিক্ষার্থী ও পর্যটকরা।

বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক জনপদ পঞ্চগড় জেলা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ইসলামবাগ এলাকায় অবস্থিত পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ ঘুরে দেখা মিলে এমন চিত্র।

জানা যায়, ১৯৯৭ সালে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অভ্যন্তরে ওই প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র এ জাদুঘরটি। হিমালয়ের কোলঘেঁষা এ জেলার ভূগর্ভের অল্প গভীরে রয়েছে প্রচুর নুড়ি আর গভীরে রয়েছে প্রাচীন যুগের শিলাস্তর। রকস মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘরটি এ শিলাস্তরের কালানুক্রমিক নমুনা নিয়ে পঞ্চগড়ে গড়ে তোলা হয়েছে।

ডোমার থেকে রকস মিউজিয়াম দেখতে আসা সাথী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, অনেকের মুখে এ জাদুঘরের কথা শুনেছি। এখানে ঐতিহ্যাসিক বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারছি।

কথা হয় বগুড়া থেকে মিউজিয়ামে ঘুরতে আসা মৌরি আক্তার মনির সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি পাথরের নাম ও সংগ্রহ পদ্ধতি লেখা রয়েছে সাইনবোর্ডে। এখানে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও স্থাপন করা হয়েছে। আরও রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার। এখানে আসার পর অনেক ভালো লাগছে।

এদিকে মিউজিয়ামে রয়েছে পঞ্চগড় অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং নদীর নিচে ও ভূগর্ভে প্রাপ্ত অশ্মীভূত কাঠ, তিনশ’ থেকে দুই হাজার বছরের পুরোনো ইমারতের ইট, পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা।  

উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে ব্যাসল্ট, বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, শেল, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাহিট, মার্বেলসহ বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে রূপান্তরিত পাথর, নকশা করা খিলান ও বিভিন্ন রেখা, লেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং ধূসর ও কালো রঙের কাদা।

কলেজের প্রভাষিক মাকসুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের মধ্যে একমাত্র এ পাথরের জাদুঘর পঞ্চগড়ে হওয়ায় প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এখানে ঘুরতে আসেন। এখানে থাকা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র ঘুরে দেখেন। তবে সবার আগ্রহ বেশি বিশাল আকৃতির পাথরগুলোর দিকে।

প্রভাষক আল ইমরান রাসেল বাংলানিউজকে বলেন, পঞ্চগড় অঞ্চলটি হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত পানির সঙ্গে বালু ভেসে আসছে। আর এ বালু থেকে প্রাকৃতিকভাবে পাথর তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ একটা সময় পর এসব পাথর বিশাল আকৃতি ধারণ করে। আর এ পাথরগুলো সংরক্ষণ করতে তৎকালীন অধ্যক্ষ নাজমুল হক এ রকস্ মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘরটি গড়ে তোলেন। তবে বর্তমান সময়ে এ মিউজিয়ামটি সঠিকভাবে চালু রাখতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, এ মিউজিয়ামে পাথরের পাশাপাশি বিভিন্ন জিনসপত্র রাখা হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই ক্লাসের পর টিফিনের সময়ে মিউজিয়ামে গিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আলোচনা করে থাকি। এতে করে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমরা সহজে জানতে পারি। একই কথা বলেন সোনিয়া আক্তার জুই নামে আরেক শিক্ষার্থী।

মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া বাংলানিউজকে বলেন, এ মিউজিয়ামে পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এখানে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা নিয়মিত আসছেন। তবে কলেজের নিজস্ব ফান্ড থেকে এ মিউজিয়ামটি ঠিকমতো পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারিভাবে যদি মিউজিয়ামটি পরিচালনায় সহায়তা করা হয়, তবে মিউজিয়ামটি আরও ভালো রূপে আনা সম্ভব হবে।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মাইনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এ মিউজিয়ামে হাজার হাজার বছর আগের অনেক পুরোনো জিনিসপত্র রয়েছে। প্রাচীনকালের অনেক পাথরের সংগ্রহ রয়েছে এ জাদুঘরে। যা দেখে শিক্ষার্থীসহ অনেকেই অতীতের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছেন। ভবিষ্যতে এ মিউজিয়ামটি আরও বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এটি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। দেশের একমাত্র এ পাথরের সংগ্রহশালাটিতে সরকারি তদারকি দরকার। এ মিউজিয়ামকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। সবার প্রচেষ্টায় মিউজিয়ামটি যেন সমৃদ্ধ হয়, আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

যেভাবে যাবেন: 

মিউজিয়ামের কোনো প্রবেশ ফি নেই। যে কেউ কলেজ টাইমে মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখতে পারেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। বাংলাদেশের যে কোনো জায়গা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে পঞ্চগড়ে যায়। ধাক্কামারা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা বা অটোরিকশায় করে সরকারি মহিলা কলেজে গেলেই দেখা মিলবে ‘রকস মিউজিয়ামে’র।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।