ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

রেলশূন্য হচ্ছে রেলের শহর!

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২২
রেলশূন্য হচ্ছে রেলের শহর!

সিরাজগঞ্জ: রেলশূন্য হয়ে যাচ্ছে এক সময়ের রেলসিটি খ্যাত সিরাজগঞ্জ শহর। ভোরের ট্রেনের বাঁশি শুনে ঘুম ভাঙতো যে শহরবাসীর, দিনভর ইঞ্জিনের ঝিকঝিক ঝিকঝিক আওয়াজের সঙ্গে হাজারও মানুষের কোলাহলে মুখর থাকতো যে শহর, সেখানে বর্তমানে নামমাত্র একটি ট্রেন চলাচল করছে।

 

উত্তরের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ শহরের পূর্বপ্রান্তে দেশের অন্যতম নদীবন্দরে ভিড়তো লঞ্চ, জাহাজ আর ফেরি। নদীবন্দর থেকে শহরে ঢুকতেই দু’দিকে বেঁকে যাওয়া রেলপথে সব সময় থাকতো কোনো না কোনো ট্রেন। তিন দশকের ব্যবধানে এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বৃটিশ-ভারত আমলে যমুনা অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ শহরটিকে গড়ে তোলা হয়েছিল রেলসিটি হিসেবেই। শহরের বুক চিরে বের হওয়া দু’টি রেলসড়ক যমুনার তীরে গিয়ে শেষ হয়। শহরের মাঝখানে ছিল রায়পুর, সিরাজগঞ্জ বাজার, সিরাজগঞ্জ ঘাট ও বাহিরগোলা চারটি রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনগুলো ঘিরেই চলতো শহরবাসীর জীবিকা। রায়পুর রেলওয়ে স্টেশনে ছিল ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ আর ঘোরানোর নানা যন্ত্রপাতি।  

১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর অবহেলা ও পরিকল্পনাহীনতায় পর্যায়ক্রমে গৌরব হারাতে বসে রেলসিটি সিরাজগঞ্জ। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পরও রাজশাহীগামী পদ্মা ও খুলনাগমী সুন্দরবন এক্সপ্রেস নামে দু’টি আন্তঃনগর ট্রেন, একটি মেইল ট্রেন ও একটি লোকান ট্রেন চলতো। পরে একে একে বন্ধ হয় এসব ট্রেন। সিরাজগঞ্জের বুকে শেষ পেরেকটি মারা হচ্ছে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলসড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। এ প্রকল্পে সিরাজগঞ্জ শহরকে রেলবঞ্চিত করার প্রক্রিয়া চলছে।

দীর্ঘদিন ধরে সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটি ও শহরবাসীর চরম বিরোধিতার পরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে জংশন স্থাপন করছে। ফলে জেলা শহরটি রেলবঞ্চিত হবে বলে আশঙ্কা সচেতন মহলের।  

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, ১৯১৫ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকার চলনবিলের বুক চিরে নির্মাণ করে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ। এতে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ট্রেনে সিরাজগঞ্জে আসার পর যমুনার ঘাট থেকে ফেরিতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করতো উত্তরাঞ্চলবাসী।  

ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথের মাধ্যমে নদীবন্দর সিরাজগঞ্জকে গড়ে তোলা হয় রেলসিটি হিসেবে। শহরেই স্থাপন করা হয় চারটি রেলওয়ে স্টেশন। সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদী ও দর্শনা হয়ে কলকাতার সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়। একটি আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ছিল, যেটা শিলিগুড়ি, দার্জিলিং হয়ে ঈশ্বরদী দিয়ে সিরাজগঞ্জে আসতো। এভাবে সিরাজগঞ্জের সঙ্গে সরাসরি কলকতার সংযোগ স্থাপিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে থাকে সিরাজগঞ্জ। এখানকার কৃষিপণ্য যেত কলকাতায় আর কলকাতা থেকে বিভিন্ন পণ্য আসতো সিরাজগঞ্জে। সকালের ট্রেনে গিয়ে রাতের ট্রেনেই ফেরা যেত। কলকাতার প্রভাবে সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও সিরাজগঞ্জ এগিয়ে যায়। সিরাজগঞ্জের হরিহর ‍শুক্লা ও তার মেয়ে হৈমন্তী শুক্লা, বাঁশরী লাহিড়ী ও তার ছেলে বাপ্পী লাহিড়ী ভারতীয় সঙ্গীতাঙ্গনে কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী কলকাতায় থাকতেন। ওনার ছেলে কলকাতা থেকে এখানে এসে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন।  

প্রবীণ রাজনীতিবিদ ডা. রাজা আরও বলেন, বগুড়া থেকে যে রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে সিরাজগঞ্জ শহরে জংশন না করলে এ রেলসিটির একেবারেই অপমৃত্যু ঘটবে। আমদানি-রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেক প্রভাব পড়বে।

জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক স্থানীয় দৈনিক যমুনা প্রবাহর সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, এক সময় সিরাজগঞ্জ শহরটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেখানে চারটি রেলওয়ে স্টেশন ছিল। রায়পুরে ছিল ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ, রেল ঘোরানো ও কয়লার ইঞ্জিন মেরামত কারখানা। অনেক যন্ত্রপাতি ছিল, এখনো ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এটা ছিল বাংলাদেশ থেকে কলকাতার কেন্দ্রভূমি। সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইলসহ সমস্ত এলাকার পাট ও কৃষিজাত দ্রব্য সিরাজগঞ্জ থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য রেললাইন প্রতিষ্ঠিত হয়।  

তিনি বলেন, এটা তো রেলভিত্তিক একটি শহর। রেলকে বাইপাস করে শহরকে আলাদা করতে পারে না। যে শহর বন্দর কেন্দ্রিক, সেটা বন্দর হবে, যে শহর রেল কেন্দ্রিক, সেটা রেলশহর থাকতে হবে। যারা এ শহরকে রেলবঞ্চিত করেছে, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই। একদিকে সরকার রেল অধ্যুষিত দেশ গড়ে তুলছে, অপরদিকে রেলশহর সিরাজগঞ্জকে বঞ্চিত করে শেষ করে দিচ্ছে একটি চক্র। অথচ ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনাসহ বিভিন্ন শহরের মধ্যেই রেলওয়ে স্টেশন করা হচ্ছে।  

রায়পুর, বাজার স্টেশন এলাকায় শত শত একর রেলের জায়গা পড়ে আছে। অথচ নতুন স্থানে জংশন করে কৃষিভিত্তিক জমিগুলো নষ্ট করার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।   

সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতা নব কুমার কর্মকার বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর রেলস্টেশন কড্ডার মোড়ে চলে গেল। আমরা তখনই বলছিলাম, সিরাজগঞ্জ শহর যদি রেল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, শহরটি হাটখোলায় পরিণত হবে। বাস্তবে তাই হলো। আমরা সেটি নিয়ে আন্দোলন করলাম, হরতাল মিছিল, মিটিং করলাম। সর্বশেষ ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জের জনসভায় ঘোষণা দিয়ে গেলেন, রায়পুর জংশন হয়ে বগুড়া পর্যন্ত রেল সংযোগ হবে। পরে রেল মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার ইন্ধনে আমাদের রেল লাইন রায়পুরের পরিবর্তে কালিয়া হরিপুর দিয়ে বগুড়ায় নেওয়া হচ্ছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অবমাননার সঙ্গে সিরাজগঞ্জের আপামর জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।  

সিরাজগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সোহরাব আলী সরকার বলেন, এক সময় আমরা দেখতাম, এখানে অনেক আন্তঃনগর, মেইল, লোকাল ট্রেন যাতায়াত করতো, সব সময় জাকজমকপূর্ণ থাকতো বাজার স্টেশন ও রায়পুর রেলওয়ে জংশন। এখন আর সেগুলো নেই। রায়পুরে জংশন না হলে রেলের জন্য বিখ্যাত সিরাজগঞ্জ শহরটা মরে যাবে।  

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান বলেন, আমরা রায়পুরে জংশন চেয়েছিলাম। শুনেছি সামান্য কিছু দূর দিয়ে রেল লাইন হবে। আন্তঃজেলা মিটিংয়ে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।  

বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীণ বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। এক সময় বাহিরগোলা বাজার দিয়ে রেল লাইন ছিল। সিরাজগঞ্জ বাজার থেকে যমুনা নদীর ঘাট পর্যন্তও রেলপথ ছিল। আমরা শহরের প্রতিটি স্থান স্টাডির আওতায় নিয়েছি। সার্বিক বিবেচনায় দেখা গেছে, রায়পুর রেল জংশন করলে জমি অধিগ্রহণে প্রচুর অর্থ ব্যয় হবে। এ কারণে রায়পুর রেলওয়ে স্টেশনের ১.২৫ কিলোমিটার দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে সিরাজগঞ্জ জংশন। এখানে পাঁচ/ছয়টি রেল লাইন থাকবে। রায়পুর স্টেশনটি সিগন্যালিং সিস্টেমের আওতায় আনা হবে। সিরাজগঞ্জের ট্রেনগুলো সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন থেকেই ছেড়ে যাবে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাকি ট্রেনগুলো রায়পুর স্টেশনের ১.২৫ কিলোমিটার দূরে অর্থাৎ সিরাজগঞ্জ জংশন দিয়েই যাবে।  

তিনি বলেন, বর্তমানে প্রকল্পের ডিটেইলস ডিজাইন প্রস্তুতের ৭৫ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে। শিগগিরিই আমরা টেন্ডারিং প্রসেসে যাবো।  

উল্লেখ্য, এ বছর জুনে বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ৮৬ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। পাঁচ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের রেলপথের নকশা তৈরি, স্টেশনের সংখ্যা নির্ধারণসহ অন্যান্য সব কাজ শেষ হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২২
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।