হঠাৎ একটা শক্ত কিছুতে হোঁচট খেলো লোকটা। সাথে সাথেই মুখটা ব্যথায় কুঁকড়ে গেল।
রাত হয়ে গেছে। চারপাশ বেশ অন্ধকার। ভালো করে দেখাও যায় না কিছু। তারপরও লোকটা নিচু হয়ে তার যন্ত্রণাকাতর পায়ের আঙুলগুলিকে দেখতে চাইলো। আর দেখতে চাইলো সেই আততায়ীকে— যে এই অনাবশ্যক যন্ত্রণায় তাকে ভোগাচ্ছে।
একটা অস্পষ্ট চারকোণা আকৃতির কোনোকিছু পড়ে আছে পায়ের সামনে। ওই তো শালা। পায়ে যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো একটা লাথিই মারতো সে জিনিসটাকে। কিন্তু ওই আশা যেহেতু পূর্ণ হচ্ছে না, লোকটা চাইলো জিনিসটাকে দূরে ছুড়ে ফেলতে। আক্রোশভরা একটা হাত নিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে জিনিসটাকে ধরতেই দেখা গেল ওটা একটা ব্রিফকেইস। কিন্তু বাবা, এতো রাতে তুমি এখানে কেন? তোমার তো একটা চমৎকার সুদৃশ্য টেবিলে শুয়ে রাত কাটানোর কথা। ওই টেবিলটা থাকবে একটা ঠাণ্ডা আরামদায়ক ঘরে। তুমি কি আজ রাতে ভরপেট মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গিয়েছিলে? পাঁড় মাতালদের মতো আর বাসায় যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছো না বলে রাস্তায় পড়ে আছো?
ব্রিফকেইস কোনো কথা না বলে শান্ত হয়ে লোকটার হাতে ঝুলতে লাগলো। সেই ঝুলনের মধ্যে এমন কোনো ছন্দহীনতা ছিল না, যাতে ব্রিফকেইসটাকে সহজেই মাতাল বলে শনাক্ত করা যায়। বরং কর্পোরেট কর্তাদের মতো একটা নিটোল গাম্ভীর্যে আগাগোড়া মোড়া ছিল সে। লোকটা ভাবলো ব্রিফকেইসটাকে চেনা দরকার। আর তার জন্য দরকার একটা আলোর। আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও সে এমন কোনো আলোর উৎস খুঁজে পেল না, যার কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানালে সদয় আলো চারদিক দৃশ্যমান করে তুলবে। কিন্তু পরিচয় জানাটাও জরুরি। অন্তত মালিককে যদি ব্রিফকেইসটা ফিরিয়ে দিতে হয়। এবং অবশ্যই দিতে হবে। কে জানে— যে এটা হারিয়েছে, সে এখন দুঃশ্চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে কিনা। এই চিন্তাটা লোকটাকে ঘরমুখী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করলো। ঘরে গিয়ে ব্রিফকেইসটার পরিচয় উদ্ধার করার পরে সকালে এর মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা যাবে। এই কয়েকটা ঘণ্টায় খুব একটা ক্ষতি হবে না নিশ্চয়ই মালিক লোকটার।
লোকটা একটা বস্তিতে থাকে। পথেঘাটে ব্রিফকেইস যদি পেতে হয়, তাহলে প্রাপকের ঘর অবশ্যই হতে হবে বস্তিতে। নইলে ফেরত দেয়ার মহত্ব কে দেখাবে? ঠিক এই কারণেই এই লোকটাও একটা বস্তিতে থাকে, পরিশ্রম করে খায় আর জীবনের কোনো এক রাতে একটা ব্রিফকেইস কুড়িয়ে পায় যেটা খোলার জন্য তাকে ঘরে ফিরতে হয় এবং কিছুটা অনুতাপও করে এইজন্য যে, ব্রিফকেইসটা ফিরিয়ে দিতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।
লোকটার ঘরে তার বউ এবং তিনটা বাচ্চাও আছে। ব্রিফকেইসটা নিয়ে সে যখন ঘরে পৌঁছালো বাচ্চাগুলি তখনো ঘুমায়নি। বাবার হাতে একটা অনিয়মিত ব্যাগ দেখে তারা হৈ হৈ করে এসে জড়িয়ে ধরলো লোকটাকে। কৌতুহলী স্ত্রী ঠিক এভাবে না হলেও চোখেমুখে ফুটিয়ে রাখলো জানার প্রবল আগ্রহ। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক, একটা দরিদ্র পরিবারে হঠাৎ কোনোকিছু এলে সেটার কাছ থেকে ভাগ্য বদলাবার সুযোগ খুঁজবে অনেকেই। বৈষম্যের সমাজে এটাকে দোষের বলে মনে করবার কিছুই নেই। কিন্তু লোকটা তো চায় ব্রিফকেইসটাকে ফেরত দিতে। এইরকম অবস্থায় এই লোভ তো ঠিক মানানসই না। ফলে লোকটা ধমকে উঠলো বাচ্চাদের আর বউকে বললো ওদের সামলে রাখতে। বউ অনেক কষ্ট করে বাপের কাছ থেকে বাচ্চাগুলিকে ছাড়িয়ে এনে শুইয়ে দিলো বিছানায়। কিন্তু তার মন তখনো বাচ্চাদের পক্ষ অবলম্বন করে আছে। ব্রিফকেইসটার ভিতরের জগতটাকে একবার হলেও দেখে প্রাণটা জুড়াতে চায় সে।
লোকটা অবশ্য এসব কিছুর ধার দিয়েই গেল না। তার এখন দরকার ব্রিফকেইসটার পরিচয় জানা। বেড়ার ফাঁকফোঁকড় খুঁজে সে বের করলো একটা জং ধরা স্ক্রু-ড্রাইভার এবং সেটাকে নিয়ে নামলো ব্রিফকেইস খোলার কাজে। প্রায় সাথে সাথেই তার মনে হলো ব্রিফকেইসের মালিক হয়তো ব্যাপারটাকে পছন্দ করবে না। গরীবদের কোনো কাজই তো পছন্দ হয় না ধনীদের। এই আশঙ্কার কারণে সে স্ক্রু-ড্রাইভারটাকে নামিয়ে রেখে ব্রিফকেইসটাকে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো কোথাও কোনো পরিচয়ের চিহ্ন আছে কিনা। প্রায় মিনিট দশেক ধরে চললো এই খোঁজার অভিযান এবং বিছানায় বসে তার বউ আর তিন বাচ্চা অপলক চোখে দেখতে লাগলো তার কাজ।
কিন্তু সব অনুসন্ধানই বিফলে গেল। শেষে নিরুপায় হয়ে লোকটা ভাবলো ব্রিফকেইসটাকে খুলতেই হবে। না হলে পরিচয় জানা যাবে না। অবশ্য এতে যদি মালিক রাগও করে, তাহলে তাকেও বুঝিয়ে বলতে হবে যে এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ব্রিফকেইসটাকে না খুললে এই বস্তির ঘরেই হয়তো সে পড়ে থাকবে বাকি জীবন এবং শেষমেষ ভাঙারি হিসাবে বিক্রি করার সময় তাকে নগ্ন করতেই হবে। তখন মালিক রাগ করলেই কি আর না করলেই কি!
আবার লোকটার হাতে উঠলো স্ক্রু-ড্রাইভার। এবং কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পরেই— এই চেষ্টাতে শুধু কৌশলই ছিল না, বরং গায়ের জোরও ছিল এবং এই কারণে ব্রিফকেইসের লকটা বোধহয় বিগড়েই গেল— খুলে গেল ডালা।
ব্রিফকেইসটা খুলবার আগে লোকটা ভেবেছিল ভিতরে কিছু কাগজপত্র, বড়জোর একটা পাসপোর্ট বা চেকবই থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু ডালা খোলার পর সে থ’ হয়ে গেল। নিটোলভাবে সাজানো টাকার ফর্সা বান্ডিলগুলি যেন অনাঘ্রাতা কুমারীর মতো একটা স্পর্শের অপেক্ষায় স্থির হয়ে শুয়ে আছে। ওই স্পর্শে থাকবে ভালোবাসা, কামনা আর মিশে যাওয়ার রোমাঞ্চকর সুখ।
একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলো লোকটার বউ। বাচ্চাগুলি বিছানা থেকে নেমে এসে ঘিরে ধরলো তাদের বাবাকে।
দুই.
রাতে বস্তির ওই ঘরটাতে আর কী কী হয়েছিল সেটা জানা যায়নি আলোর অভাবে। লোকটা তার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল বলেই তৈরি হয়েছিল অজ্ঞানতার অন্ধকার। কিন্তু পরের দিন সকালে আবার সূর্য উঠতেই সবকিছু পরিষ্কার দেখা গেল।
দেখা যাওয়া সেই দৃশ্যের মধ্যে ছিল দরজা খোলা ঘরটা আর তার মধ্যে পড়ে থাকা পাঁচটা মানুষের চামড়ার খোলস।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৪