ঢাকা, রবিবার, ১ পৌষ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফুটবল

যেভাবে সালাউদ্দিনের প্রশ্রয়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক সোহাগ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, স্পোর্টস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৩
যেভাবে সালাউদ্দিনের প্রশ্রয়ে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক সোহাগ

গত কয়েক বছর ধরেই বাফুফে মানেই আবু নাঈম সোহাগ। ফেডারেশনের সব কিছুতেই তাকে পাওয়া যায় সবার আগে।

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের আস্থাভাজন সোহাগ বাফুফেতে যোগ দিয়েছিলেন কম্পিটিশন ম্যানেজার হিসেবে; ২০০৫ সালে।

বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল, নটরডেম কলেজের পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় তিনি স্নাতক করেন। দেশের শীর্ষ সব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে সোহাগ বসতে পারতেন দেশের অন্যতম সেরা সব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারে। হতে পারতেন নগর পরিকল্পনাবিদ। সেটা না করে ২০০৬ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে; কম্পিটিশনস ম্যানেজার হিসেবে। দেশের ফুটবলে তখন বেহাল দশা। তাই পেশা হিসেবে সেই চাকুরি মোটেই লোভনীয় কিছু নয়। তারপরও তিনি থেকে গেলেন কোনো এক অদৃশ্য কারণেই।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে এসেছে। সেই সময় সংগঠকরা সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত/নির্বাচিত হতেন। ২০০৮ সালে গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক পদে সংগঠকের পরিবর্তে পেশাদার কাউকে নিয়োগের বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত হয় এবং সভাপতি হন ফেডারেশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

কম্পিটিশন ম্যানেজার থেকে ভাগ্যজোরে সোহাগের কাছে ২০১১ সালে চলে আসে বাফুফের নির্বাহী ক্ষমতা। প্রথম বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক আল মুসাব্বির সাদীর অকাল মৃত্যুর পর সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সেসময় সোহাগকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেন। পরের বছর থেকে তিনি পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক। তাকে নিয়োগ দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে সেসময় সালাউদ্দিন জানিয়েছিলেন, ‘আমার হাতে যোগ্য বিকল্প নেই’। ফেডারেশনে তখন এক্সিকিউটিভের সংখ্যা কম ছিল এবং সোহাগ সেই সময় ছিল সবার মধ্যে অভিজ্ঞ এবং উচ্চশিক্ষিত।

ক্রমেই তিনি বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। সালাউদ্দিন এতটাই সোহাগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, অনেক সময় নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তাদের চেয়ে সোহাগের মন্তব্য বা পরামর্শকেই বেশি মূল্য দিতে থাকেন। বিশেষ করে সালাউদ্দিন তৃতীয় মেয়াদে বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সোহাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

বাফুফেতে একসময় ক্রীড়াঙ্গনের অনেকেরই আসা যাওয়া ছিল। ছিল ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভিড়। তবে বিভিন্ন নিরাপত্তার অজুহাতে সকলের অবাধ যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন সোহাগ। ফেডারেশনের মূল প্রশাসনিক জায়গা হলো দ্বিতীয় তলা। সেখানে তারা কয়েক স্তরের নিরাপত্তা তৈরি করেন। এর ফলে সাবেক ফুটবলারদের অনেক সংগঠকই ফেডারেশনে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হন।

ফিফা প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়ান্নি ইনফান্তিনো আসার পর থেকেই ফরোয়ার্ড পোগ্রাম চালু করেন সোহাগ। এরপর বাফুফেতে আসতে থাকে ভালো পরিমাণ অনুদান। ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র সহ-সভাপতি হলেও আর্থিক ব্যবস্থাপনাতে সোহাগের ভূমিকাই ছিল বেশি। এমনকি সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের স্বাক্ষর খুব কম থাকলেও আর্থিক বিষয়ে সভাপতির মাধ্যমে সোহাগ প্রভাব খাটিয়েছেন বলে ধারণা ফুটবল ফেডারেশনের অধিকাংশের। ফিফার এথিকস কমিটি যে তদন্ত করেছে সেখানে ২০১৬-২০ সালের আর্থিক বিষয়গুলোই মূলত উঠে এসেছে।  

সোহাগ সালাউদ্দিনের আস্থাভাজন হওয়ায় অনেক কর্মকর্তা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে বিষয়টি নীরবে চেপে গেছেন। সাবেক তারকা ফুটবলার বাদল রায় ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি ফেডারেশনের অনিয়ম নিয়ে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। ব্রেন-স্ট্রোক থেকে সেরে ওঠে ফেডারেশনে আবার কর্মকাণ্ড শুরু করলে, সোহাগের সঙ্গে তার বাকবিতন্ডা হয় এবং আকস্মিকভাবে ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সেই সময় সোহাগের পক্ষই নেন। সাবেক অনেক ফুটবলার সোহাগের শাস্তি দাবি করলেও, বাফুফে সভাপতি কোনো পদক্ষেপই নেননি।

সেই চাপা ক্ষোভ মনে রেখেই বাদল রায় ২০২০ সালে দুনিয়া ত্যাগ করেন। তার মতো প্রতিবাদী লোক ফেডারেশনের কমিটিতে না থাকায় সোহাগের জবাবদিহিতার মাত্রা আরও কমে যায়। সহ-সভাপতিদের মধ্যে বাদল রায়ই প্রতিনিয়ত ফেডারেশনে যেতেন। ২০২০ সালে নির্বাচিত সহ-সভাপতিরা ফেডারেশনে সেভাবে নিয়মিত নন। সদস্যদের বসার জন্য সুনির্দিষ্ট কক্ষও নেই (মহিলা ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছাড়া)। ফলে ফেডারেশনে সোহাগের একচ্ছত্র প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

সোহাগের বিরূদ্ধে প্রায়ই ওঠা নানা অভিযোগ এক লহমায় উড়িয়ে দিয়ে সালাউদ্দিন বারবারই তাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। সোহাগের ঢাল হয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমকেও ফুটবলের শত্রু তকমা দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। এমনকি ফিফা সোহাগের বিপক্ষে তদন্ত শুরু করার পরও সালাউদ্দিন বাফুফের পক্ষ থেকে কোনরকম ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটেননি। উল্টো কি করে তাকে বাঁচানো যায় সেই ফন্দি এঁটেছেন।

গত ফেব্রুয়ারির এক ঘটনায় সোহাগের প্রতি সালাউদ্দিনের রহস্যময় অন্ধ বিশ্বাসের নজির মিলেছে। ফেব্রুয়ারিতে সোহাগ বাফুফেতে তার অধস্তন তিন কর্মকর্তাকে নিয়ে গোপনে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফা সদরদপ্তরে গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নিতে। এ নিয়ে তুলকালাম শুরুর পর সালাউদ্দিন দাবি করেন, ‘সোহাগসহ চার অফিসিয়াল ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত খরচে জুরিখ যান। তাদের জুরিখ সফরের খরচ বাফুফে নয়, তবে অন্য কেউ বহন করেছেন। ’

সোহাগ বাকি তিনজনকে নিয়ে গেলেন মূলত ফিফার জেরার মুখে যাতে তালগোল পাকিয়ে না ফেলেন, সেই সুবিধার্থে। চার অফিসিয়াল ফিরে আসার পর সোহাগকে পাশে বসিয়ে সালাউদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে বোঝাতে চেয়েছেন তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যে।

২০২০-২৩ এই সময়কালে সোহাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানকে অনুমতি বা অবহিত না করেই তিনি অনেক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়েছেন। অনেক সময় সভাপতিকে এসব বিষয়ে জানালেও তেমন কোনো প্রতিকার আসেনি। অর্থ, প্রশাসন ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নসহ সব কিছুতেই সোহাগ গত তিন বছর অত্যন্ত ফ্রি স্টাইল ছিলেন। যার কারণে বলা চলে, সাম্প্রতিক সময়ে মূলত সোহাগই পরিচালনা করেছেন ফুটবল ফেডারেশন। অনেক ক্ষেত্রে কাজী সালাউদ্দিন সোহাগের পরামর্শকে সিদ্ধান্তে রূপ দিয়েছেন বলে জানা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সাধারণ সম্পাদক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সহ-সভাপতিদের বেশিরভাগেরই ফোন ধরতেন না। এই বিষয়ে সোহাগকে প্রশ্রয় দিয়ে সালাউদ্দিন সাম্প্রতিক সময়ে বলেছিলেন, ‘সোহাগ তো আমার ফোনও ধরে না। সোহাগকে এসএমএস করি- কল মি। এরপর ও ফোন করে। ’

দেশকে ফাঁকি দিলেও ফিফার জালে ঠিকই ধরা পড়তে হলো সোহাগকে। নিষেধাজ্ঞা পেলেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন তিনি। তার জন্য ফিফা সভাপতি সঙ্গে আলোচনা করার কথাও জানিয়েছেন সালাউদ্দিন। সোহাগের নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে ডানহাত কাটা পড়েছে বাফুফে সভাপতির। এবার সাম্রাজ্য সামলাতে কী পদক্ষেপ নেবেন বাফুফে বস? ফেডারেশন সূত্রে অনেকেই বলছেন নিষেধাজ্ঞায় থাকলেও বাইরে থেকে ঠিকই ফেডারেশনের কলকাঠি নাড়তে চেষ্টা চালিয়ে যাবেন সোহাগ।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২৩
এআর/আরইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।