কারো মৃত্যুর পর মৃতের বাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা কম বেশি অনেকেরই আছে। বয়োজ্যোষ্ঠ কেউ মারা গেলে, ছেলেমেয়েরা যদি দূরে থাকে, দেখা যায় মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তারা আসছেন; অন্য স্বজনরা তাদের রিকশা কিংবা গাড়ি থেকে নামিয়ে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাচ্ছেন।
ওইদিন ব্রাজিল-জার্মানি ম্যাচের পর বেলো হরিজন্ত-তে ছিলো এরকম দৃশ্য। জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের জন্য আশ্রয় হতে হয়েছিলো অন্যদের। তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য যেনো কোনো মৃতের বাড়ি।
অথবা প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে নেইমারের ফিরে আসার দৃশ্যটি রিউইন্ড করে দেখুন। মনে হয়, নেইমার যাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন সেই দিয়াগো সিলভারা যেনো কারো মৃত্যুতে শোকে কাতর। প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডও যেনো এমন এক বাড়ি যেখানে মাত্রই মৃত্যু একজনের।
মৃত্যুর চেয়ে কম কি ছিলো ওই রাতে! নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ১-৭ গোলের পরাজয় তো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অতীত গৌরবের মৃত্যুর সঙ্গেই তুলনীয়।
সেই গৌরবের আজ কি তা হলে কুলখানি! নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে আজকের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটিকে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক দু’ দিক থেকেই কুলখানির সঙ্গে তুলনা করা যায়।
কারো মৃত্যুর তৃতীয় বা চতুর্থ দিন কুলখানির আয়োজন হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের প্রথা। এর ধর্মীয় দিকের সঙ্গে কিন্তু শোকাহত পরিবারের জন্য একটা মনস্ত¡াত্ত্বিক দিকও আছে। কুলখানিতে যে শুধু মৃতের আত্মার শান্তিই কামনা করা হয় এমন নয়। কুলখানিতে স্বজন হারানো পরিবারের কাছের-দূরের অনেকে আসেন। দোয়া-খায়ের-আপ্যায়নের সঙ্গে একটা পুনর্মিলনীর উপলক্ষও হয়ে উঠে কুলখানি, যা পরিবারটিকে শোকের পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে কিছুটা হলেও সহায়তা করে।
আজকের ম্যাচটি ব্রাজিলের জন্য ওইরকমই। জার্মানির সঙ্গে ফুটবল গৌরবের যে মৃত্যু, কিছুটা হলেও তা ভোলার উপলক্ষ হতে পারে এই ম্যাচ। কিছুটা হলেও সান্ত¡নার প্রলেপ হতে পারে একটি জয়।
কিন্তু অনেকে ব্রাজিলের লজ্জাজনক পরাজয়কে মশকরা করে যে ‘সেভেন-আপ’ নাম দিয়েছেন সেই ‘সিতে’র হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠা এতো সহজ না যে মাত্র চারদিনের মাথায় একই দল সব উল্টেপাল্টে দেবে। বরং এরকম যে কোনো চেষ্টা সেমিফাইনালের পুনরাবৃত্তিই করতে পারে। নেইমার-দিয়াগো সিলভা ছাড়াও সবকিছু উল্টেপাল্টে দেয়ার উত্তেজনা থেকেই তো ব্রাজিলের গোল খাওয়ার শুরু, এরপর সেটা যেনো ক্রিকেটের কোনো স্কোর।
তারপরও এটা কুলখানির মতোই এক ম্যাচ। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে কারো মৃত্যুর পর দেখা যায়, কুলখানি উপলক্ষে এক হয়েই সম্পত্তির ভাগাভাগিসহ শোকগ্রস্ত পরিবারের অনেক নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত। ৭-১ এ পরাজয়ের পর প্রথম মাঠে নেমে আজকের ম্যাচে ব্রাজিলও আরো ভালো করে তার ভুলগুলো বুঝতে পারবে, যার ভিত্তিতে ঠিক হবে ভবিষ্যৎ দলের গতিপথ।
তবে আজও যে ব্রাজিল পা হড়কাতে পারে তার কারণ প্রতিপক্ষের নাম নেদারল্যান্ডস। ফাইনালে উঠা দু’ দল জার্মানি এবং আর্জেন্টিনার মতো নেদারল্যান্ডসও এবারের বিশ্বকাপে অপরাজিত দল। সেমিফাইনালে তাদের হার টাইব্রেকারে, ম্যাচের রেজাল্ট কিন্তু গোলশূন্য ড্র। তারাও নিশ্চয়ই চাইবে অন্ততঃ জয় দিয়েই শেষ হোক তাদের বিশ্বকাপ মিশন।
তারপরও তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ বিশ্বকাপের দাবিদার যে কোনো দলের জন্যই বিরক্তিকর এবং বিব্রতকর। ডাচ কোচ লুই ফন গাল পরিস্কারভাবেই তা বলেছেন। এই ম্যাচে তাদের হেরে যাওয়া মানে, পুরো বিশ্বকাপে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে, পুরো বিশ্বকাপে অপরাজিত থেকে শেষ পর্যন্ত পরাজয়ে বাড়ি ফেরা।
অনুল্লেখ্য কোনো দল সেমিফাইনালে না উঠলে সবার জন্যই একই অনুভূতি। হয় তো ব্রাজিলের জন্য এবারের স্থান নির্ধারণী ম্যাচটা একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটের, নিজেদের কিছুটা ফিরে পাওয়ার একটা উপলক্ষ। তারপরও তো দিনশেষে এটা স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। রানার্সআপকেই যেখানে কেউ মনে রাখে না সেখানে কে মনে রাখতে চায় বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া দলের নাম।
তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ তাই হৃদয়ের জ্বলুনি। একদিন পর যেখানে নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেয়ে আলোতে উজ্জ্বল হবে মারকানা, সেখানে ব্রাসিলিয়ার আজকের খেলা যেনো ভাব-গম্বীর পরিবেশের এক ম্যাচ। তাই ফাইনাল যদি হয় কারো পুনর্জাগরণের, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ আসরের কুলখানি। ব্রাজিলিয়ানদের জন্য দুর্ভাগ্য যে হোস্ট হয়েও ব্রাজিলকেই খেলতে হচ্ছে সেই কুলখানির ম্যাচ, তাও সেমিতে ৭-১ এ বিধ্বস্ত হওয়ার পর।
বাংলাদেশ সময় ১৮১১ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৪