শচীন টেন্ডুলকার গ্রেট ক্রিকেটার। রাহুল দ্রাবিড় কিংবা স্টিভ ওয়াহ।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে ক্রিকেটারদের ব্যাটিং আপনার চোখে লেগে আছে তার মধ্যে নিশ্চয়ই আছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, হার্শেল গিবস, মাহেন্দ্র সিং ধোনি, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, কেভিন পিটারসেন, যুবরাজ সিং, ক্রিস গেইল, বীরেন্দর শেবাগ, শহীদ আফ্রিদি অথবা সানাথ জয়সুরিয়ার নাম।
যোগ্যতায় অতটা না হোক, তারপরও আপনি যে কারণে ওই নামগুলো বলছেন, সেই বিবেচনায় মোহাম্মদ আশরাফুল কিংবা তামিম ইকবালের কথাও আসবে।
এ সব নামে একটা বিষয় বেশ কমন। সে কারণেই তাদের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়।
কারণটা জিজ্ঞেস করলে সবাই একবাক্যে নিশ্চয়ই বলবেন, এরা সবাই খুনে ব্যাটসম্যান। যেমন খুনে বোলার ছিলেন ওয়াসিম আকরাম আর শেন ওয়ার্ন, কিংবা বর্তমান সময়ের ডেল স্টেইন। এই ক্রিকেটাররা কি আপনার প্রিয় না? নিশ্চয়ই প্রিয়।
এদের খুনে চরিত্রই তাদের বোলিং বা ব্যাটিং ভালো লাগার কারণ। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দিতে এই খুনে মানসিকতা খুবই জরুরি। ফুটবলে এরকম দলের তালিকার শীর্ষে জার্মানি। এই জার্মানরা বাংলাদেশে যে খুব জনপ্রিয় এমন নয়।
আমাদের দেশে এক মাশরাফি ছাড়া আগুনে চরিত্রের আর ক্রিকেটার নেই বলে বাংলাদেশিদের অনেক আফসোস থাকলেও বিশ্ব ফুটবলের মাঠে খুনে চরিত্রের দল জার্মানি তাদের কাছে খুব একটা পাত্তা পায় না।
জার্মানরা সুন্দর ফুটবল খেললেও তাদের কথিত যান্ত্রিক নাম দেওয়া হয়। জার্মানরা সুন্দর ফুটবল খেলে সফল হলেও বলা হয়, মাঠে খেলেছে কিছু রোবট। কিন্তু একই খেলা অন্য কেউ খেললে বলা হয়, অমুকের ম্যাজিক কিংবা তমুকের পায়ের যাদু।
বিষয়টা আসলে মানসিকতার। আগে আরো ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শুধু রেডিও আর পত্রিকা অতটা মন ভরাতে পারতো না বলে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের জয়জয়কার টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারে, ১৯৮২ সালে। মাঠের খেলা যেহেতু ঘরের ড্রয়িংরুমে, কিংবা হোস্টেলের টিভিরুমে অথবা অডিটোরিয়ামে; বাঙালিরও তাই দর্শক হিসেবে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ তখন থেকেই।
সেই অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় নাম এর আগে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া পেলের দেশ ব্রাজিল, আর আগের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ম্যারাডোনোর আর্জেন্টিনা। তবে বাংলাদেশিদের সমর্থনের পাল্লাটা তখন ব্রাজিলের দিকেই ছিলো বেশি। ওই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি, তারপরও সমর্থনের অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো যেটা ফুলে-ফলে পূর্ণতা পায় ৮৬ বিশ্বকাপে, ম্যারাডোনার প্রায় একক নৈপুণ্যে তার হাতে বিশ্বকাপ।
এরপর তো ৯০ বিশ্বকাপে রেফারির সিদ্ধান্তে ফাইনালে হেরে ম্যারাডোনার সেই বুক ভাসানো বিখ্যাত কান্না, যার ফল হিসেবে কাঁদুনে বাঙালির আরো বেশি আর্জেন্টিনা সমর্থন হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ৮২-৮৬-৯০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল সাফল্য না পেলেও প্রথমে জিকো-সক্রেটিস-ফ্যালকাও-জুনিয়র এবং পরে রোমারিওদের খেলায় মুগ্ধ ছিলো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সব সমর্থক।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিল-ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনাল তো এখনো অনেকের চোখে সেরা বিশ্বকাপ ম্যাচ। তারপরও সাফল্য আসে নি। কিন্তু ৯৪ বিশ্বকাপে রোমারিও-বেবেটো এবং ২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদো-রোনালদিনহো-রিভালদোদের হাতে, আসলে পায়ে লুটিয়ে পড়লো বিশ্বকাপ। বাংলাদেশে তাই একদিকে যেমন প্রথমে ম্যারাডোনা এবং গত কয়েক বছরে মেসির কারণে আর্জেন্টিনার জন্য জোয়ারের মতো সমর্থনের পাল্লা ভারি, তেমনি ব্রাজিলের জন্য একটু বয়সীদের সঙ্গে নতুন নতুন সমর্থক।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা অবশ্যই সুন্দর ফুটবল খেলে, তারপরও বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো তাদের জন্য বাঙালির সমর্থনের সেটাই একমাত্র কারণ না। এর প্রথম কারণ মনস্তাত্ত্বিক। সেটা হলো ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা দু’টি দেশই লাতিন।
জন্মগতভাবে বাঙালির ইউরোপ-আমেরিকাবিরোধী সেন্টিমেন্টের কারণে তারা প্রথমে ফুটবলে সফল ওই দুটি দেশ বেছে নিয়েছে, এরপর বাঙালির বীরপূজার সংস্কৃতির কারণে তারা বীরও পেয়েছে। দুয়ে মিলে সোনায় সোহাগা। তাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কখনো কখনো জঘন্য ফুটবল খেললেও সমর্থকদের অনেকের কাছে কষ্টের পরও প্রশ্ন নেই। যে বীরদের তারা পূজা করে, তারা সম্মান ধূলায় লুটিয়ে দিলেও সেটাকেও তারা পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রই মনে করে।
তবে ফুটবলে সমর্থন অনেকটা পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ধর্মের মতো। সাধারণভাবে ধর্ম যেমন পরিবর্তন করা যায় না, তেমনি খেলায় জীবনের প্রথম থেকে যে দলকে অন্ধভাবে সমর্থন সেটাও বদলে ফেলা সম্ভব নয়।
কিন্তু তার মানে এই না যে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ছাড়া আর কোনো দল সুন্দর ফুটবল খেলে না। বরং বাস্তবতা হচ্ছে, ইউরোপীয় দলগুলো তাদের সুন্দর ফুটবলের সঙ্গে এমন রণকৌশল ঠিক করে নিচ্ছে যেটাতে সাফল্য আসছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো জার্মানি। ৮২ সালে বাঙালির যে বিশ্বকাপ দর্শন (ওয়াচ) এবং দর্শন (ফিলোসফি) শুরু, তখন থেকেই তাদের সেইরকম সাফল্য। পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের সঙ্গে এই সাফল্যই বরং কিছু ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমর্থন না পাওয়ার কারণ হয়েছে। একে তো তাদের কাছে বাঙালির প্রিয় দলের ট্র্যাজেডি, অন্যদিকে জার্মানির খুব বেশি ট্র্যাজেডির শিকার না হওয়ার উদাহরণ।
বাঙালি সত্যিই দু:খবিলাসী, ট্র্যাজেডিই তার প্রেম, ট্র্যাজেডিই তার পরিণতি।
তবে সময় পাল্টাচ্ছে। দু’ দশক আগে বাংলাদেশে যে জার্মানির সমর্থক খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপ লাগতো, সেই জার্মানির সমর্থক এখন খুব একটা কম নয়। এর কারণ বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করা নতুন প্রজন্ম। তারা শুধু ভাবালুতায়, তথাকথিত আফ্রো-এশিয়-লাতিন সেন্টিমেন্টে না ভুগে যুক্তির বাছ-বিচারে সমর্থনের দল খুঁজে নিচ্ছে। আমি-আপনি না হয় আগে শুধু ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ অবস্থায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রেমে পড়েছি। কিন্তু নতুনরা হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের চর্চাও করেছে।
পায়ের যাদুর সঙ্গে সেই মস্তিষ্কের ব্যবহারটাই করছে জার্মানরা। এবার সেমিফাইনালে ব্রাজিলের ৭ গোল হয় তো দুর্ঘটনা, কিন্তু ৪-১ বা ৪-২ হলে সেটাই হতো স্বাভাবিক। গত বিশ্বকাপেই তো মেসিসহ আর্জেন্টিনা এই জার্মানির কাছে ৪-২ গোলে হেরেছিলো। এমনকি এর আগের বিশ্বকাপেও কোয়ার্টার ফাইনালেই জার্মানির কাছে হেরেছিলো আর্জেন্টিনা। তার আগের বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানরা ব্রাজিলের কাছে হেরে গেলেও এরপর বিশ্বকাপে এ দু’দলের কাছে তাদের আর পরাজয় নেই। এর মানে হচ্ছে, জার্মানরা বুঝে গেছে যে তাদের বিশ্বকাপ যাত্রায় কোনো না কোনোভাবে বড় বাধা হতে পারে আর্জেন্টিনা অথবা ব্রাজিল, সুতরাং তারা এমনভাবে গেমপ্ল্যান সাজাচ্ছে যেখানে হৃদয় ভাঙা পরাজয়ে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার বিদায়।
তবে মস্তিষ্কের সঙ্গে হৃদয়ের পরিচয়টাও অনেক বড়ই দিয়েছে জার্মানি। একবার ভাবুন তো ব্রাজিলের সঙ্গে তাদের ৭-১ গোলের জয় পরবর্তী কিছু মুহূর্ত। জয়টা তাদের জন্য স্বাভাবিক, কিন্তু ব্রাজিলের সঙ্গে এতোবড় জয় স্বাভাবিক না; তাই ওই জয়ের পর আনন্দটা উদযাপন করলেও তারা ব্রাজিলিয়ানদের উপযুক্ত সম্মানটাও দেখিয়েছে। এমনকি জার্মান সমর্থকরাও ছিলো তাদের প্লেয়ারদের মতোই সংবেদনশীল।
জার্মান ফুটবল দল এভাবে তাদের হৃদয় দিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। তবে তাদের সৃষ্টিশীল ‘সাকসিসটা' ফুটবলেও হৃদয় জয় করেছে আরো কোটি দর্শকের। আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশে নিশ্চয়ই জার্মানদের জন্য এবারের চেয়ে সমর্থন থাকবে কয়েক গুণ। বাংলাদেশেও অনেকের হৃদয়ের দল হবে জার্মানি।
**মেসির সামনে বার্লিন প্রাচীর
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৪