নড়াইল থেকে ফিরে: নড়াইল শহর থেকে শেখহাটি ইউনিয়নের হাতিয়ারা, গুয়াখোলা ও বাকলি গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১৮-২০ কিলোমিটার। সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এ গ্রামের মেয়েরা খেলবে ফুটবল, হয়ে উঠবে পেশাদার ফুটবলার-এমনটা স্বপ্নেও কেউ ভেবেছে কি না সন্দেহ।
তবে ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগে নড়াইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা হয়ে উঠেছেন পেশাদার ফুটবলার। খেলছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্লাব, বয়সভিত্তিক দলগুলোতে। ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ পাল্টে দিয়েছে নড়াইলের নারী ফুটবলকে। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে দিতে তৈরি হচ্ছে প্রমীলা ফুটবলাররা।
শুরুর কথা গল্পের মতোই মনে হতে পারে। ২০১০ সালের ২৪ জুলাই নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে হাতিয়ারা গ্রামের পুতুল মজুমদার ও বিচিত্রা বিশ্বাস কয়েকজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে আয়োজন করলেন বিবাহিত ও অবিবাহিত মেয়েদের মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ।
এক টিমে মা, প্রতিপক্ষ টিমে আবার তারই মেয়ে! ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেন নড়াইলের মানুষ। অবিবাহিতদের জয়ের ম্যাচটি দারুণ উপভোগ করেন নড়াইল জেলার প্রায় ১৫ হাজার দর্শক। নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাসহ সব দর্শক নারী ফুটবলারদের খেলা দেখে মুগ্ধ।
আগের রাতে মাইকিং শুনে ম্যাচ কাভার করতে মাঠে যান দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার সাংবাদিক ও সাবেক ফুটবলার কার্ত্তিক দাস। নারী ফুটবলারদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার চিত্র যেন সেখানে বসেই দেখে ফেলেন নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার তালিকাভুক্ত এ ফুটবল কোচ।
এরপর ওই মাঠেই নিয়মিত অনুশীলন করাতে লাগলেন নারী ফুটবলারদের। তিনি বলেন, আমার চিন্তা আসলো গ্রামেই যদি নারীদের ফুটবল এত জনপ্রিয় হয় তাহলে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের টিম কেন তৈরি করছি না। ওই মাঠে এক-দেড় মাসের মতো ফুটবল অনুশীলন করাই।
মাঠ ছোট হওয়ায় ওখানে থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠে (নড়াইল সদর) চলে আসি। মা ও স্কুল পড়ুয়া মেয়ে মিলে ৪৪ জনকে নিয়ে কাজ শুরু করি। এক পর্যায়ে মায়েদের বুঝিয়ে বলি, আপনাদের কাছ থেকে তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। তাছাড়া সময় বের করতেও আপনাদের অনেক কষ্ট হবে। আপনারা অবসর নিয়ে নেন, আপনাদের মেয়েরাই খেলুক।
এরপর এগিয়ে আসে বেসরকারি এনজিও সংস্থা ‘বাঁচতে শেখা’। ‘জ্যোতি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা’ গঠন করে গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে এ সময় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাবেক জাতীয় ফুটবল তারকা শেখ মোহাম্মদ আসলামও মেয়েদের ১০টি ফুটবল, কয়েকটি জার্সি ও শর্টস কিনে দেন।
পত্রিকায় নিউজ হওয়ার পরই কয়েকটি এনজিও উৎসাহ পায় সহযোগিতা করতে জানান কার্তিক। তিনি বলেন, পত্রিকায় নিউজ হওয়াতে এনজিওরা উৎসাহ পেল। তারা এখানে (ভিক্টোরিয়ার কলেজ মাঠ) এসে অনুশীলন দেখলো।
তারা বললো, অর্থনৈতিক সাহায্য দিলে আপনি নেবেন কিনা। আমি বললাম, এটাতো খুব ভালো কথা, এতগুলো মেয়ে প্রাকটিস করছে। সাহায্য করলে তো মেয়েগুলোর ভালোই হবে। তখন থেকে তাদের সহযোগিতা।
১৮-২০ কিলোমিটার দূরে এসে অনুশীলন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। এ জন্য এনজিও নসিমন ও ভ্যানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ফুটবলারদের যাতায়াতের জন্য। বিকেলে দল বেঁধে অনুশীলনে আসে মেয়েরা, আবার দল বেঁধে গন্তব্যে ফেরে। অনুশীলন শেষে খেলোয়াড়দের খেতে দেওয়া হয় ডিম, কলা ও রুটি। নাস্তার বাজেট ২০ টাকা।
জ্যোতি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার আইন সালিশীর বিচার সম্পাদক কবিতা বিশ্বাস দেখভাল করেন এই ৩৩ জন মেয়েকে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক সমস্যারও সমাধান দেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী।
কবিতা বিশ্বস বলেন, যখন দেখি শর্মিলা, বিপাশারা বাইরে খেলতে যায়। তখন খুব ভালো লাগে। ওরা বিদেশে গিয়ে যেন প্রথম হতে পারে এজন্য আমি পরিশ্রম করি। মেয়েদের কিছু হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই, জল এনে খাওয়াই, নাস্তা দেই। ৩৩টা মেয়ের দায়িত্ব আমার।
মাঝে মাঝে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও যেতে হয় কবিতা বিশ্বাসকে। উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা বিরক্ত করে মেয়ে ফুটবলারদের। ‘সপ্তাহখানেক আগে একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিল একটা ছেলে। আমাদের একটা মেয়েকে বলে তোকে বিয়ে করবো। সেখানে গিয়ে সমাধান দিয়েছি। আমরা বাল্য বিয়ে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করি’- বলেন কবিতা বিশ্বাস।
ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠে ৮ মাস অনুশীলনের পরই এক এক করে সাফল্য পেতে শুরু করে এখানকার মেয়েরা। গত কয়েক বছরে অনেক অনেক সাফল্য যোগ হয়েছে নড়াইলের নারী ফুটবলারদের।
মেয়েদের সাফল্যগাঁথা নিয়ে কোচ কার্ত্তিক দাস বলছিলেন, ২০১২ সালে যখন ফু্টবল লিগ হলো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১০ জন নারী খেলোয়াড়ের মধ্যে বিউটি, বিপাশা, রুনা, শর্মিলা ও রনি খেলেছেন ওয়ারি ক্লাবে এবং সরস্বতী, প্রতিমা, বিচিত্রা, শেফালি ও শ্যামলী খেলেছেন আরামবাগ কাবে।
এছাড়া বিপাশা, রুনা, পদ্মাবতী ও বিউটি বিশ্বাস অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে। পদ্মাবতী জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ায়ও খেলেছে। ’
২০১৩ সালে নড়াইলের ১৪জন নারী ফুটবলার বিভিন্ন ক্লাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বলে জানান কার্ত্তিক দাস। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনূর্ধ্ব-১৪ প্রমীলা ফুটবল টুর্নামেন্ট হলো, সেখানে জাতীয় দলে বিপাশা ও শর্মিলা খেলেছে। ওখানে আমাদের বাংলাদেশ টিম চ্যাম্পিয়ন হয়।
ইরানের সাথে যখন খেলা হয় তখন বিপাশা অধিনায়কত্ব করে। দুটি গোল করে আর দুটি গোল করায়। ’একদিন এখানকার ১১টা মেয়ে এক সঙ্গে খেলবে জাতীয় দলে- এমন স্বপ্ন নিয়ে কড়া শাসনে কার্ত্তিক দাস গড়ে তুলছেন নারী ফুটবলারদের। কোচের এই নিরলস চেষ্টা নিশ্চয়ই বিফলে যেতে দেবে না প্রতিভাবান এ ফুটবলাররা।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৬
এসকে/এমজেএফ/
** অতীতের দিকে তাকালে চোখে পানি চলে আসে
** দুই মৌসুম ধরে বন্ধ খুলনা লিগ
** নারী ক্রিকেট মানেই তো সালমা
** মাঠের মানুষ আব্দুস সাত্তার কচি
** জাতীয় দলে ফিরবেন, বিশ্বাস জিয়ার
** লক্ষ্যটা নিজের ভেতরেই রাখতে চান সোহান
** ‘মাশরাফি ভাইয়ের রুমেই বেশী আড্ডা হতো’
** আবু নাসের স্টেডিয়াম যেভাবে ‘লাকি ভেন্যু’ হলো
** ক্রিকেটভক্ত-ক্রিকেটারভক্ত মিম, আফরিদ
** বিশ্বকাপের ক্যাচ দুটি মনে রাখবেন সৌম্য
** ‘লাল-সবুজ’ বাড়ির বাসিন্দা সৌম্য
** সৌম্যর সুন্দরবন-ট্রিপ
** মাশরাফিতে মুগ্ধ মুস্তাফিজের বাবা
** মুস্তাফিজের বোলিংটাই কেবল পাল্টেছে
** ‘কাটার স্পেশালিস্ট’ এর শুরু এ মাঠেই
** গ্রামের বাড়িতে দুরন্ত মুস্তাফিজ
** ক্রিকেটাঙ্গনে দাপট দেখানো খুলনার পথে…