ঢাকা: পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের ফুটবল গভীর সংকটে পতিত হয়েছে। সবশেষ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলের লজ্জাজনক হার, পরপর দুই বার কোপা আমেরিকা থেকে হতাশাজনক বিদায়ই তার প্রমাণ।
একক জাতি হিসেবে ফুটবল বিশ্বকে যে নান্দনিকতা ও অপার সৌন্দর্য উপহার দিয়েছে ব্রাজিল তার সমতুল্য নয় অন্য কোনো দেশ। ‘Football: the English invented it, the Brazilians perfected it.’ -বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যকে সত্য প্রমাণ করে যুগে যুগে এসেছে পেলে, টোস্টাও, গ্যারিঞ্চা, জেয়ারজিনহো, জিকো, সক্রেতিস, রোমারিও, জর্জিনহো, রোনালদো, রোনালদিনহোর মতো এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। রিও ডি জেনেইরোর বস্তির ফুটবল, সমুদ্র সৈকতের ‘বিচ ফুটবল’ কিংবা সাও পাওলোর ফুটপাতের ফুটবল থেকে উঠে এসেছে অগণিত সুপারস্টার। ব্রাজিলে ফুটবল প্রতিভার ঘাটতি কখনোই হয়নি এখনও নেই; তারই সাক্ষী হালের ফুটবলে নেইমার বা কুতিনহোর মতো খেলোয়াড়।
এরপরেও ব্রাজিলের সোনালি দিন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে, পাঁচতারকা খচিত সোনালি জার্সি হয়ে পড়েছে ফিকে। শিরোপা জয়ে শিরোনাম হওয়া যে দলের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য, সেই সেলেকাওরা বর্তমানে কেবল ফুটবলের মুনাফা অর্জনেই শীর্ষে। আগাগোড়া দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়া ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) দেশটির ফুটবল ঐতিহ্যকেই করেছে মলিন।
যখনই ব্রাজিলের ফুটবল সংকটে পড়ে তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে কেউ না কেউ হাজির হন বিশ্বমঞ্চে। ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ২৪ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়ে ফের ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ এনে কোচ আলবার্তো পেরেইরা। এবার বিশালাকার দেশটির ফুটবলের নেতৃত্বভার তুলে নিয়েছেন অ্যাদেনোর লিওনার্দো বাচ্চি।
‘তিতে’ নামে পরিচিত করিন্থিয়ান্সের এই ট্যাকটিসিয়ান বরখাস্ত হওয়া কার্লোস দুঙ্গার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। ব্রাজিলের ফুটবল সমর্থকরা এখন তাকিয়ে তার দিকে। দুঙ্গার প্রাগম্যাটিক ফুটবলের বিপক্ষে তিতে আবার জাগাবেন জোগো বনিতো ফুটবল (নান্দনিক ফুটবল) সেই আশায় বুক বাঁধছেন ফুটবল পাগল ব্রাজিলীয় সমর্থকরা। দর্শক-সমর্থকদের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন দেশব্যাপী জনপ্রিয় এই কোচ।
যদিও গত চার বছর আগেই ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন তিতে। কিন্তু শেষমেষ তা হয়নি। মানো মাজেসের বদলে কোচ হয়ে আসেন লুই ফেলিপে স্কোলারি। স্কলারি বরখাস্ত হওয়ার পর আবার কোচের আলোচনায় নাম আসে তিতের। কিন্তু বোর্ডের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ায় তা হয়ে ওঠেনি। গত বছর কোপা আমেরিকা থেকে ছিটকে যাওয়ার পর ব্রাজিলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে ফিরিয়ে দেন তিতে। কেননা বোর্ডের হর্তকর্তাদের সঙ্গে তার ফুটবল দর্শন মেলেনি। কোচ হিসেবে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা নিয়েই এবার জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নিলেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার আগে নিজের সমস্ত শর্ত পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন বোর্ডকে।
বিশ্বব্যাপী খুব পরিচিত না হলেও ব্রাজিলে তুমুল জনপ্রিয় তিতে ২০১০ সালে করিন্থিয়ান্সের দায়িত্ব নিয়ে ভঙ্গুর একটি দলকে নিয়ে যান সাফল্যের তুঙ্গে। দি তিমাও (বড় ক্লাব) খ্যাত করিন্থিয়ান্সের দায়িত্ব যখন নেন তিতে তখন দলটির নাজুক দশা। লিগের দুই-তৃতীয়াংশ ম্যাচ খেলে ফেলা এবং টানা ১০ ম্যাচে পরাজিত হয়ে তলানিতে চলে গিয়েছিলো করিন্থিয়ান্স। ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ক্লাবের করুণ এই দশায় হাল ধরেন তিতে। তলানি থেকে ওই বছরই অবশিষ্ট সবগুলো ম্যাচ জিতিয়ে ক্লাবটিকে তুলে নেন তৃতীয় স্থানে। পরের বছর ২০১১ সালে তিতের অধীনে ব্রাজিলের লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় করিন্থিয়ান্স।
২০১২ সালে লাতিন অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খ্যাত কোপা লিবার্তোদোরেস জেতে তিতের করিন্থিয়ান্স। যে দলটি নিয়ে লিবার্তোদোরেস জেতেন তিতে সেই দলে ছিল না উল্লেখ করার মতো কোনো ফুটবল তারকা। দলের ভেতর সংহতি গড়ে তুলে, তরুণ খেলোয়াড়দের সুযোগ দিয়ে নিজের রণকৌশল সাজিয়ে দলকে এনে দেন শিরোপা।
করিন্থিয়ান্সের দায়িত্ব নিয়ে তিনি সামনে আনেন এক অদ্ভুত কৌশল। ২০১১ সালে তার অধীনে থাকা দলে যেহেতু ছিল না কোনো সুপার স্টার, আক্রমণে ছিল না কোনো ক্ষুরধার স্ট্রাইকার তাই তিনি দল সাজান ৪-৬-০ ফরমেশনে। স্ট্রাইকিংয়ে কোনো ফোকাল প্লেয়ার না রেখে মাঝমাঠের পরিপূর্ণ দখল নিয়ে এক জমাট দল গড়ে তোলেন তিতে। ওই বছর তার দল সবচেয়ে কম গোল হজম করে লিগ শিরোপা জেতে।
২০১২ সালে দলের ফরমেশন আমূল বদলে ফেলেন তিতে। এবার তিনি দলের আক্রমণে আনেন মুন্সিয়ানা। আগের বছরের রক্ষণাত্মক ফুটবল বদলে যায় তুমুল আক্রমণাত্মক কৌশলে। তিনি ফিরে আসেন ৪-২-৩-১ ফরমেশনে। আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে করিন্থিয়ান্স ২০১২ সালে জেতে লাতিন অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ‘কোপা লিবার্তোদোরেস’। লাতিন অঞ্চলের সেরা হয়েই থেমে থাকেনি করিন্থিয়ান্স, একই বছর ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন দল চেলসিকে হারিয়ে ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের শিরোপাও জেতে তিতের করিস্থিয়ান্স।
এরপর ২০১৩ সালে করিন্থিয়ান্সের দায়িত্ব ছেড়ে ইউরোপ ট্যুরে বের হন তিতে। ইউরোপীয় ফুটবলের খোল-নলচে জানতে ঘুরে বেড়ান টানা দুই বছর। তিতেকে হারিয়ে ফের বিপদে পড়ে করিন্থিয়ান্স। আবারও তিনি দায়িত্ব নিয়ে সমর্থকদের হতাশ করেননি তিতে। ইউরোপ ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে তিতে হয়ে ওঠেন আরও কৌশলী আরও আক্রমণাত্মক। ২০১৫ সালে তিতের করিন্থিয়ান্স সবচেয়ে বেশি গোল করে এবং সবচেয়ে কম গোল হজমের রেকর্ড গড়ে ঘরে তোলে লিগ শিরোপা।
শিরোপা অর্জনই তিতের ফুটবল দর্শনের প্রধান দিক নয়; খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস যোগানো, তাদের একসুতোয় গাঁথা, দলের ভেতর সংহতি গড়ে তোলা, তারকা নির্ভরতা ও ‘ওয়ানম্যানশিপ’ কাটিয়ে একাট্টা দল গড়ে তোলায় ওস্তাদ তিতে।
জাতীয় দলের দায়িত্ব নিতে সম্মত হওয়ার পর সৎ ও স্পষ্টভাষী তিতেকে হারানোর আক্ষেপে ফুটবল ক্লাব করিন্থিয়ান্সের প্রেসিডেন্ট আক্ষেপ করে বলেন, ‘ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন তিতের মতো কোচের যোগ্য নয়, তার মতো নৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে কাজে অভ্যস্ত নয় ফেডারেশন। ’
অভিযোগ রয়েছে জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচনে নাক গলায় ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন। ফেডারেশন নির্বাচক কমিটি বা কোচকে বাধ্য করে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্টের খেলোয়াড়দের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে। এখন দেখার বিষয় মুনাফালোভী ফুটবল ফেডারেশনের অধীনে নিজের দলকে কীভাবে গড়ে তোলেন তিতের মতো ব্যক্তিত্ব। শুধু শিরোপা জয়ই ব্রাজিল সমর্থকদের একমাত্র কাম্য নয়। জোগো বনিতো ফুটবল নিশ্চিত করতে না পারলে সমর্থকদের ভালোবাসা জোটে না সফলতম ব্যক্তির কপালেও। খাদের কিনার থেকে দলকে টেনে তুলতে, সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে এই মুহূর্তে তিতে ভিন্ন অন্য কোনো সুযোগই ছিল না ব্রাজিলের।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৬
এমজেএফ/