ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুটবল

তুর্কি কিংবদন্তি হাকান সুকুর এখন উবার চালক!

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
তুর্কি কিংবদন্তি হাকান সুকুর এখন উবার চালক! বিশ্বকাপে ইতিহাস গড়া হাকান সুকুর এখন উবার চালক (ডানে)

২০০২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ। দর্শক তখনো ঠিকঠাকভাবে নিজেদের আসনে বসতে পারেননি। এর মধ্যেই মাত্র ১০.৮ সেকেন্ডেই হাকান সুকুরের গোল! লক্ষ্যভেদ করেই পাখির ডানা মেলার মতো হাত দুটো দুই পাশে ছড়িয়ে যেন উড়ে যেতে চাইলেন। তবে সতীর্থরা অবশ্য তাকে উড়ে যেতে দেননি। ভালোবাসা আর আদরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তাকে। সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম গোলের মালিক বনে যাওয়া সেই সুকুরকে মনে আছে? 

দেগুর বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামের ৬৩ হাজার দর্শক আর টেলিভিশনের পর্দায় ম্যাচ উপভোগ করা কোটি কোটি মানুষ ওই গোলের কথা ভোলার কথা নয়। কিন্তু ব্যক্তি সুকুরকে কয়জন মনে রেখেছেন? বাকিদের কথা বাদ দিন, খোদ তুরস্কের মানুষই তাকে ভুলে গেছে।

শুধু ভুলে গেছে বলাটাও ভুল হবে, কারণ সরকারের রোষানলে পড়ে নিজ দেশ থেকেই বিতাড়িত হয়েছেন ইতিহাস গড়া এই ফুটবলার।  

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন সুকুর। শুধু কি তাই, জীবিকার তাগিদে তিনি এখন অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সার্ভিস উবার’র ড্রাইভার। ট্যাক্সি চালানোর পাশাপাশি বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা সুকুর দাবি করেছেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগান তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন।

তুরস্ক, গ্যালাতাসারাই, ইন্টার মিলান ও ব্যাকবার্নের সাবেক এই স্ট্রাইকার জানিয়েছেন, তাকে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে তার সব সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ফলে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। অথচ একসময় পুরো তুরস্কের রাস্তায় রাস্তায় তার ছবি আর পোস্টার শোভা পেতো। তাকে দেশটির জাতীয় বীর উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ২৫০-এর বেশি গোল করেছিলেন সুকুর। আর দেশের জার্সিতে ১১২ ম্যাচে ৫১ গোল নিয়ে হয়েছিলেন তুর্কি ফুটবলপ্রেমীদের চোখের মণি। কিন্তু ঝামেলার শুরু অবসর নেওয়ার পর। শুরুতে কিছুদিন ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করলেও এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একেপি) পার্টিতে নাম লেখান তিনি।  

এরদোগানের দলের হয়ে পার্লামেন্টের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন সুকুর। কিন্তু দলের সঙ্গে তার মতের অমিল হতেই সব পাল্টে যায়। এরদোগানের বন্ধু, রাজনৈতিক সহচর এবং লেখক ফেতুল্লা গুলেনের ‘গুলেন আন্দোলন’ (বহুজাতিক ইসলামিক ও সামাজিক আন্দোলন) তখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এরদোগান এটা মানতে পারেননি। ফলে দুই পক্ষের বিবাদ শুরু হয়।  

‘গুলেন আন্দোলন’র কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ক্রামার স্কুল বন্ধ করে দেয় এরদোগান সরকার। এর প্রতিবাদে সরব হন সুকুর। দল থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। মূলত সেখান থেকেই শুরু। এরপর টুইটারে এরদোগান সরকারের সমালোচনা করে আরও বিরাগভাজন হন। শুধু তাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তব্যে ‘আমি তুর্কি নই, আমি আলবেনিয়ান’ বলার পর নিজ দেশের মানুষের সমর্থনও হারিয়ে ফেলেন তিনি।

সরকারের সমালোচনার ফলে ২০১৬ সালের জুনে সুকুরের বিচার শুরু হয়। বিচারকার্যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়। এরপরই পরিবার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। তো কেমন আছেন এই কিংবদন্তি? এই প্রশ্নের জবাবেই ‘উবার চালক’ হিসেবে নিজের দুর্বিষহ জীবনের কথা জানান তিনি।

তুরস্কের সরকারের সমালোচনা করার পর তার ও তার পরিবারকে কতটা ঝড় সামলাতে হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সুকুর বলেন, ‘২০১৩ সালে একেপি থেকে সরে যাওয়ার পর থেকেই ভয়াবহ আচরণের শুরু। আমার স্ত্রীর বুটিক শপে লোকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করে, রাস্তায় আমার সন্তানদের উত্যক্ত করা হতো। আমার প্রতিটি বিবৃতির পর আমাকে হুমকি দেওয়া হতো। আমি যখন দেশ ছাড়লাম, তারা (তুরস্ক সরকার) আমার বাবাকে আটকে রাখে এবং আমার সব সম্পদ জব্দ করে। ’

‘পৃথিবীতে আমার কিছুই নেই। এরদোগান আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন। আমার স্বাধীনতার অধিকার, আমার কথা বলার অধিকার এবং কাজ করার অধিকারও। ’

সুকুরের বাবা এখনও গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। এর আগে ক্যান্সারের চিকিৎসার কারণে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার মা নিজেও ক্যান্সারে আক্রান্ত। আক্ষেপ নিয়ে সুকুর বলেন, ‘এটা তাদের (বাবা-মা) জন্য খুব কঠিন সময়। আমার সঙ্গে যারাই সম্পর্কিত তাদের সবাইকে আর্থিক ঝামেলার মুখে পড়তে হচ্ছে। ’

ট্যাক্সি ক্যাব চালানোর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি ক্যাফে চালু করেছিলেন সুকুর। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কিছু অপরিচিত লোক সেখানে হাজির হয়ে ‘ডোম্বরা মিউজিক’ বাজাতে শুরু করে। এই বিশেষ মিউজিককে একেপি পার্টি তুর্কিদের ঐতিহ্যবাহী ও সত্যিকারের মিউজিক বলে দাবি করে।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুকুরের সঙ্গে সেলফি তোলার অপরাধে এক তুর্কি শিক্ষার্থীকে নাকি ১৪ মাস জেলও খাটতে হয়েছে। অথচ সবকিছু আগে এমন ছিল না। সুকুর বলেন, ‘আমি যখন একেপিতে যোগ দিলাম, তুরস্ক তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউরোপ থেকে অনেক বিনিয়োগও আসতে শুরু করে। কিন্তু এরদোগানের বাজে রাজনীতি সব পাল্টে দেয়। দেশ তখন উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে। ’

‘অন্য অনেক দেশের মতো তুরস্কেও ফুটবল স্বাধীন নয়। কিন্তু কথা বলার দায়ে আমাদের তুরস্কের মিডিয়া আক্রমণ করে। তারা এটা নিশ্চিত হতে চায় যে, অন্য অ্যাথলেটরাও যেন মুখ খুলতে ভয় পায়। আমি আমার দেশে যেসব কাজ আইনি শুধু সেসব কাজই করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেহেতু আমার নাম হাকান সুকুর, তাই তারা (তুরস্ক সরকার) আমার নাম ব্যবহার করে বাকিদের দমিয়ে রাখতো। ’

‘আমার কোনো অপরাধ কর্মের কোনো তালিকা কি তারা দেখাতে পারবে? না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমাকে বিশ্বাসঘাতক এবং সন্ত্রাসী বলে ডাকে। আমি সরকারের শত্রু, কিন্তু দেশের নই। আমি আমার দেশ এবং দেশের পতাকাকে ভালোবাসি। ’

গ্যালাতাসারাইয়ে ১৩ বছরের ক্যারিয়ার শেষে ২০১৭ সালে সুকুরকে ক্লাবের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত যে সরাসরি এরদোগানের পক্ষ থেকেই এসেছে সেটা ভালো করেই জানেন সুকুর, ‘এটা ক্রীড়া মন্ত্রী নয়, প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত ছিল। কোনো কোর্ট রুলিং ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত শীর্ষ পর্যায় থেকেই কেবল আসতে পারে। ’

সবশেষে, এরদোগানের সঙ্গে আর্সেনালের জার্মান মিডফিল্ডার মেসুত ওজিল ও ম্যানচেস্টার সিটি তারকা ইকাই গুন্দোগানের ২০১৮ সালে তোলা বিতর্কিত ছবির ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলে সুকুর বলেন, ‘আমার মনে হয় ছবিটি তেমন আহামরি নয়। তাদের অবশ্যই যে দেশের হয়ে খেলছে (জার্মানি) সেই দেশের প্রতি সম্মন প্রদর্শন করা উচিত। আমি বরং ওজিল এবং গুন্দোগানকে বলবো একেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য। তাহলেই তারা পার্টির আসল চেহারা দেখতে পারবে। ’ 

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।