ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

শিশুদের নিয়ে হরলিক্স প্রতারণা!

আদনান রহমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪
শিশুদের নিয়ে হরলিক্স প্রতারণা!

ঢাকাঃ আইনি প্রক্রিয়া না মেনে নিজেদের ইচ্ছামাফিক দেশের সর্বত্র জুনিয়র হরলিক্স বিক্রি করছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ। পাশাপাশি এবার প্যাকেটের গায়ে শিশুদের বয়স সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়ন ও আইন ফাঁকি দিতে এবার শিশুদের সঙ্গে তাদের খাব‍ার নিয়েই প্রতারণা শুরু করেছে জুনিয়র হরলিক্স। ট্যাগ পাল্টে এক বয়সের জন্য প্রযোজ্য হরলিক্স বিক্রি হচ্ছে অন্য বয়ঃসীমার শিশুদের কাছে।

শিশুদের জন্য তৈরি জুনিয়র হরলিক্সের নীল জারের পেছনে ‘পাঁচ বছরের উর্ধ্বে শিশুদের জন্য’ কথাটি মুদ্রিত রয়েছে। তবে এই পরিবর্তনটি এসেছে মে মাসের ১ তারিখে। এর আগে একই জারে ২-৫ বছরের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য কথাটি উল্লেখ ছিল।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইনটি প্রণয়নের পরপরই এই সিদ্ধান্ত নেয় গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন। আইনে ২-৫ বছরের শিশুদের জন্য তৈরি খাদ্যের বিপণনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে। জারের মোড়ক, ছবি, শব্দ ও বর্ণ ছাপানোর বেশকিছু নীতিমালা প্রনয়ণ করা হয় আইনটিতে।

সেগুলো পরিবর্তনে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদন এবং অল্প কিছু সরকারি ফি দিতে হতো। এটা এড়াতে শিশুদের বয়সভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার কথা চিন্তা না করেই  একই জুনিয়র হরলিক্সের প্যাকেটে বয়স পরিবর্তন করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২-৫ বছরের শিশুদের পুরনো জুনিয়র হরলিক্সের একটি জারে দেখা গেল, এটি তৈরিতে দুধ, ময়দা, শুকনা বার্লি, চিনি, খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে। পরিবর্তীত নতুন জারেও একই উপাদান মিললো।

হরলিক্স-এর এই খাদ্যগুন নিয়ে বাংলানিউজের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনিস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম মাওলার সঙ্গে। তিনি বলেন, এমনিতেই কোন প্রাকৃতিক উপাদান ড্রাই করলে তার গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়। ২-৫ বছর কিংবা ৫ এর অধিক যাই হোক, হরলিক্স হজমশক্তিতে সাহায্যতো করেই না উল্টো এটি খেলে হজমসাধ্যতা কমে যায়, কারন এতে ন্যচারাল (প্রাকৃতিক) কোন উপাদান নেই। ‘হজমশক্তি’ বৃদ্ধি একটি বাণিজ্যিক কথা। আর যে খাদ্য ২-৫ বছরের জন্য উপযোগী তা ৫ বছর বয়সীদের জন্য কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখেনা।

এদিকে পুরনো হরলিক্সের মত নতুন হরলিক্সেও ভিটামিন বি ১ , বি ২, বি ৬ আয়রন এবং আয়োডিনে সমৃদ্ধতার কথা উল্লেখ রয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে শুধু বয়স।

আর এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের হাজারো মা যারা নিয়মিত তাদের শিশুদের জুনিয়র হরলিক্স খাওয়াচ্ছেন।

মোহাম্মদপুরের গৃহিনী তানিয়া আহমেদ তার ৪ বছরের সন্তানকে দুবছর বয়স থেকে ছেলেকে জুনিয়র হরলিক্স দিয়ে আসছেন। প্রতিমাসের মত মে মাসেও ছেলের জন্য বাজার থেকে জুনিয়র হরলিক্সের প্যাকেট কিনে ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই করে চোখ পড়লো প্যাকের গায়ে ‘পাঁচ বছরের উর্ধ্বে শিশুদের জন্য’। একই ধরনের জারে বয়সের পরিবর্তন দেখে বিভ্রান্ত হলেন তিনি। শিশুকে হরলিক্স খাওয়াবেন কি খাওয়াবে না তা নিয়ে ধন্ধে পড়লেন।
অভিযোগটি বাংলানিউজের হাতে এলে ওই গৃহীনীর হয়ে ছদ্মবেশে ভোক্তা সেজে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে ফোন দেয়া হয় হরলিক্সের হটলাইন নম্বরে (০৯৬৭৮৩৩৩৪৭৫)। জানতে চাওয়া হলো , “হটাৎ করেই প্যাকেটের বয়স পরিবর্তন। ৩ বছরের শিশুকে এই হরলিক্স খাওয়াতে পারবোতো। ” উত্তর এলো, “এটা আগেরই হরলিক্স। যে কোন বয়সী শিশুকে নির্দ্বিধায় খাওয়াতে পারবেন। ”

হরলিক্স হটলাইন থেকে পাওয়া এই বক্তব্য রেকর্ডকৃত।

এরপর বাংলানিউজের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি যোগাযোগ করা হয় গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ম্যানেজার রুমানা আহমেদের সঙ্গে। বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন তিনি। বললেন, এব্যপারে খোলাখুলি কিছু বলার ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন মহলের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে ইমেইল দিন সেখানে উত্তর দেওয়া হবে।

বাংলানিউজের পক্ষ থেকে এরপর ই-মেইল পাঠালেও রুমানা আহমেদের সাড়া মেলেনি।

এদিকে একটি সুত্র জানায়, বিএসটিআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজসে কৈশলে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে হরলিক্সের গুনগত মানে পরিবর্তন না করে, মোড়কটিও একই রেখে, স্রেফ বয়সের ট্যাগ পাল্টে এই হরলিক্স বাজারজাত করা হচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, পুরো বিষয়টি বিএসটিআই’র জানা থাকলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু বয়স পরিবর্তন নয় এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে আইনের আরও কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ।

আইনের ৪ এর (অ) ধারায়, এসব খাদ্যের সঙ্গে কোনরূপ ডিসকাউন্ট কুপন, মূল্যহ্রাস বা বিনামূল্যে কোন সামগ্রী প্রদান না করার নির্দেশ থাকলেও শিশুদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জুনিয়র হরলিক্সের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে টিফিন বক্স।

আইনের ১৪ (১) ধারা অনুযায়ী কোনো কোম্পানি এধরণের অপরাধ করলে কোম্পানির পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব, অংশীদার, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী উক্ত অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে গণ্য করার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে কৌশলে এই আইনের লঙ্ঘনের কারনে এর বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়নি অনুমোদিত কোন সংস্থা।

** আইন ভেঙ্গে বাংলাদেশে হরলিক্স বিক্রি

বাংলাদেশ সময়ঃ ১১৩৫ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।