ঢাকা, সোমবার, ১১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জুন ২০২৪, ১৬ জিলহজ ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

খুলনার স্বাস্থ্যসেবা-১

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবায় ধস

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবায় ধস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: খুলনার নয়টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানরা অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছেন। এ কারণে সরকারি এ হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য সেবায় ধস নেমেছে।



সকালে কিছুটা সময়ের জন্য ডাক্তারদের সরকারি হাসপাতালে দেখা গেলেও জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগগুলোতে অধিকাংশ সময়ই তারা থাকেন না। চিকিৎসকদের এ অনুপস্থিতিতে নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের স্বেচ্ছাচারিতায় ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগীরা।
 
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষের জন্য রয়েছে একটি মাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার স্বল্পতা ও এক্সরে বিভাগ বন্ধ হয়ে আছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সটি প্রায় সব সময় অকেজো হয়েই থাকে। চাহিদার তুলনায় এখানে ওষুধ, স্যালাইনের স্বল্পতা তো আছেই, সেই সঙ্গে এক্সরে ও প্যাথলজি সমস্যা রোগীদের দুর্ভোগকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।

জানা যায়, ১৯ জুন ডুমুরিয়ার হাসপাতালে নতুন এক্সরে ও আল্ট্রসোনো মেশিন আনা হয়েছে। কিন্তু, দুই মাস অতিবাহিত হলেও মেশিন স্থাপন করা হয়নি। স্থানীয় সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আগস্ট মাসের মধ্যে হাসপাতালে মেশিন স্থাপনের নির্দেশ দিলেও মাস শেষ হতে চললেও তা স্থাপন করা হয়নি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ডুমুরিয়া সদরসহ উপজেলার দুর্গম এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী এসে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। রোগীদের ভিড়ে অনেক সময় চিকিৎসকরা বিরক্ত হন।

এ ছাড়া প্রায় সময়ই রোগীদের ফ্লোরে বা বারান্দায় পড়ে থাকতে হয় ।

এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শয্যা রয়েছে মাত্র ৫০টি, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ হাসপাতালে যে সব রোগী আসেন, তার শতকরা ৯০ ভাগকে খুলনা শহরে পাঠানো হয়।
Khulna_health_1
ডুমুরিয়া বাজারের আব্দুল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, দালালদের মাধ্যমে সরকারি চিকিৎসকরা মোটা অংকের অর্থের বিনিয়মে রোগীদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে।

খর্ণিয়া এলাকার ভুক্তভোগী এক রোগী জানান, হাসপাতালের টেকনিশিয়ান শহিদুল ইসলাম সপ্তাহে এক দিন ডিউটিতে আসেন। হাসপাতালের ভেতরে যেসব উন্নতমানের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি আছে, তাতে পরীক্ষা না করে পকেট ভারী করার জন্য বাইরের ক্লিনিকে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পাঠান।

হাসপাতালের এক নার্স বলেন, বেশির ভাগ চিকিৎসক উপজেলা পর্যায় আসতে অনীহা প্রকাশ করায় চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকে। সে কারণে অনেক সময় আমাদের চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করতে হয়।  

সুস্মিতা নামে এক রোগীর মা অভিযোগ করেন, সরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসা হয়। যেমনটি হয়েছে, ডুমুরিয়া উপজেলা হাসপাতালে তার ছোট মেয়ের বেলায়। সেখানকার ডাক্তাররা বলেছেন, নাড়িতে প্যাঁচ পড়েছে। কিন্তু, খুলনায় এসে জানা যায়, তা সত্য নয়!
 
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শিকদার আলী আকবর শুক্রবার রাতে বাংলানিউজকে বলেন, কিছু সংকট রয়েছে, যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
 
প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশের পরও এক্সরে ও আল্ট্রসোনো মেশিন স্থাপন না হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লোক আসার কথা ছিল, আসেনি। আর কিছু যন্ত্রাংশ ঢাকা থেকে আনাতে হবে বলে সময় লাগছে।

টেকনিশিয়ান শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. শিকদার আলী আকবর বলেন, মেশিনপত্র না থাকায় তার কোনো কাজ ছিল না। এ কারণে ও নিয়মিত আসেনি। তবে ও খুব ভালো ছেলে। কাজে খুব এক্সপার্ট।
 
ঘটনা-২
কপাল থেকে প্রচণ্ড রক্তরক্ষণ হচ্ছে। থেঁতলে গেছে দুই পায়ের আঙুল। এমন অবস্থায় রূপসা উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তৌহিদুলকে।

সড়ক দুর্ঘটনার পর জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি। কয়েক জন নার্সকে মোবাইল ফোনে কথা বলতে দেখা গেলেও তারা কেউ এগিয়ে আসেননি।

পরে তৌহিদুলকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সর্ম্পকে এমন অভিযোগ তোলেন, সড়ক দুর্ঘনায় আহত তৌহিদুলের চাচাতো ভাই আব্দুল হামিদ।  

চিকিৎসক ও কর্মচারী সংকট, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবসহ নানাবিধ অনিয়মের কারণে তেরখাদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দারুণভাবে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

আউটডোরে রোগীদের ভিড়ে অনেক সময় তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। এ অবস্থায় তেরখাদাবাসীকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এ জন্য কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। অবহেলিত ও গরিব জনঅধ্যুষিত এবং অনেকদিনের জলাবদ্ধ ভুতিয়ার বিলের পাশে বসবাসকারীরা চিকিৎসা সেবা না পেয়ে দুঃখ-কষ্টে ভুগছেন। এমনটি জানালেন হাসপাতালের পাশের বাসিন্দা আব্দুস সামাদ।
Khulna_health_2
তিনি জানান, এখানে নেই অপারেশন থিয়েটার। নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। ছোটখাটো ফোঁড়া অপারেশন করতে হলেও খুলনায় যেতে হয়।

ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রোগী আল-আমিন বলেন, প্রতিদিন সুইপার এসে জরুরি বিভাগের সামনে, ডাক্তারের চেম্বার, নার্স রুম পরিস্কার করে চলে যায়। পুরুষ ওয়ার্ড কিংবা মহিলা ওয়ার্ড ঝাড় দেওয়া হলেও বাথরুম পরিস্কারসহ অন্যান্য জায়গা পরিস্কার বা ঝাড় দেওয়া হয় না। ফলে দুর্গন্ধ লেগেই থাকে।

তিনি জানান, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে দুর্গন্ধে তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

দিঘলিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্পর্কে অভিযোগ করে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, সরকারি ওষুধ গরিবরা পায় না। গ্রামের হত-দরিদ্র রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি যায়।

পরে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারেন না। এই গরিব মানুষেরা কাউকে নালিশ করতেও জানেন না।

দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধেও রোগীদের রয়েছে নানা অভিযোগ।

আইলা ও সিডর দুর্গত এ তিন উপজেলার স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অতি দরিদ্রদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় ওষুধ কম দেওয়া হয়। বার বার ঘুরিয়ে ওষুধ দেওয়া হয়। সাধারণ কিছু ওষুধ ছাড়া অধিকাংশ ওষুধই থাকে না।

হাসপাতালে গেলে প্রাইভেট ডাক্তার দেখাতে বলা হয়। অতি দরিদ্র বুঝতে পারলে চিকিৎসকরা সেবায় অমনোযোগী হন।

একই অবস্থা বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।
 
নয়টি উপজেলার প্রধান সমস্যাই চিকিৎসক সংকট। সম্প্রতি, নতুন যে সব চিকিৎসক নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে তেমন কেউ এ সব হাসপাতালে যোগদান করেননি।

এ বিষয়ে খুলনা সিভিল সার্জন ডা. ইয়াসিন আলী সরদার বাংলানিউজকে বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। আশা করি, অচিরেই তা লাঘব হবে।

নতুন ছয় হাজার ৮৯ জন চিকিৎসকের কতজন এসব হাসপাতালে যোগ দেবেন, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি ঢাকার বিষয়; আমি বলতে পারবো না।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মামুন পারভেজ বাংলানিউজকে বলেন, খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালে ছয়শ তিনজন চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। এসব শূন্য পদে সরকার নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছে।

আশা করছি, অচিরেই চিকিৎসক সংকট কেটে যাবে। তবে কতজন চিকিৎসক খুলনায় আসবেন, সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি তিনি।


** ওয়ার্ড বয় যেখানে সার্জন

 
বাংলাদশে সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।