এক মেয়াদ হোয়াইট হাউসে কাটিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত লড়াইয়ে হেরে গিয়ে ফের প্রার্থী হয়েছেন তিনি।
প্রথমবার তার পরিচিতি ও প্রচারশৈলী অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের ভোটে হারিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। ৭৮ বছরের এ রিপাবলিকান সব ‘প্রতিকূলতা’ উপেক্ষা করে এবার ‘অত্যাশ্চর্য’ রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঘটাতে চাইছেন।
স্কুলে খারাপ আচরণ শুরু করায় ১৩ বছর বয়সে ট্রাম্পকে ‘নিউ ইয়র্ক মিলিটারি অ্যাকাডেমি’তে পাঠানো হয়েছিল। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুল থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
একসময় ভাগ্য সহায় হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের। বড় ভাই ফ্রেড ট্রাম্প জুনিয়র পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাবার অনুগ্রহে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প)।
ডিগ্রি অর্জনের পর ট্রাম্প রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। তার দাবি, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য বাবার কাছ থেকে ‘সামান্য’ পরিমাণে ঋণ নিতে হয়েছিল তাকে। এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ডলার।
বাবার মালিকানাধীন বিস্তৃত ব্যবসাগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক সিটি বোরো এলাকার আবাসিক প্রকল্পে সাহায্য করতেন ট্রাম্প। ১৯৭১ সালে এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট বানানো হয় তাকে। কোম্পানির পরিবর্তন করে রাখেন ‘ট্রাম্প অরগানাইজেশন’।
বাবা ফ্রেড ট্রাম্পকে নিজের ‘অনুপ্রেরণা’ বলে বর্ণনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৯ সালে তাকে হারান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মাদকাসক্তির কারণে ফ্রেড ট্রাম্পের মৃত্যু হয় ৪৩ বছর বয়সে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরা জানান, এ কারণেই সারাজীবন মদ ও সিগারেট এড়িয়ে চলেছেন তিনি (ডোনাল্ড ট্রাম্প)।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে তাদের পারিবারিক ব্যবসার ফোকাস ব্রুকলিন ও কুইন্সের আবাসিক প্রকল্পের বদলে চলে যায় চাকচিক্যময় ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের দিকে।
বিখ্যাত ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত ট্রাম্প টাওয়ার যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে নামি সম্পত্তির মধ্যে একটি। বহু বছর ধরেই এটিই ট্রাম্পের বাসস্থল। তার নেতৃত্বে ‘কমোডোর হোটেল’কে পুনর্নির্মাণ করে ‘গ্র্যান্ড হায়াত’-এ রূপান্তরিত করা হয়। এই প্রকল্প তাকে পরিচিতি এনে দেয়।
ট্রাম্পের ব্র্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত ক্যাসিনো, কনডোমিনিয়াম বা কন্ডো (আবাসিক প্রকল্প যেখানে পৃথক মালিকানাধীন আবাসিক ইউনিট রয়েছে) গলফ কোর্স ও হোটেল রয়েছে আটলান্টিক সিটি, শিকাগো ও লাস ভেগাস থেকে শুরু করে ভারত, তুরস্ক ও ফিলিপাইনে।
বিনোদন জগতেও তিনি একজন বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব। বিনোদন জগতে তার খ্যাতি তৈরি হয় প্রথমে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ এবং মিস টিন ইউএসএ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থার মালিক হিসেবে এবং তারপর এনবিসি রিয়েলিটি শো ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’-এর স্রষ্টা হিসেবে।
ট্রাম্প বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। বিভিন্ন চলচ্চিত্র এবং প্রো-রেসলিং অনুষ্ঠানে পানীয় থেকে নেকটাইসহ অনেক কিছুই ‘বিক্রি’ করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার মোট সম্পদের পরিমাণ কমে গেছে, ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।
ট্রাম্প ছয়বার ব্যবসায় দেউলিয়া হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। ট্রাম্প স্টিকস ও ট্রাম্প বিশ্ববিদ্যালয়সহ তার বেশ কয়েকটি উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি তার আয়কর সংক্রান্ত তথ্য পরীক্ষা হওয়ার হাত থেকে থেকে আড়াল করেছেন। ২০২০ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে বছরের পর বছর আয়কর এড়ানোর অভিযোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্থিক ক্ষতির বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল।
ট্রাম্পের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ইভানা জেলনিকোভা। তিনি একজন চেক ক্রীড়াবিদ এবং মডেল ছিলেন। তাদের তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। ১৯৯০ সালে এ দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
তার দ্বিতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী মার্লা ম্যাপলস। এ যুগলের একমাত্র সন্তান টিফানির জন্মের দুই মাস পর ১৯৯৩ সালে মার্লা ম্যাপলস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। ১৯৯৯ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
ট্রাম্পের বর্তমান স্ত্রী হলেন সাবেক স্লোভেনিয়ান মডেল মেলানিয়া ট্রাম্প। তারা ২০০৫ সালে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প নামে এক পুত্রও আছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত জীবনে একাধিক বিতর্কিত অধ্যায় রয়েছে। একাধিকবার যৌন নির্যাতন ও বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে দুই পৃথক জুরি রায় দেয়, লেখিকা ই জিন ক্যারলের তার বিরুদ্ধে তোলা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই লেখিকার মানহানি করেছেন।
এ মামলায় তাকে মোট আট কোটি ৮০ লাখ ডলার দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও এই রায়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প আপিল করেছেন।
২০০৬ সালে পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ ধামাচাপা দিতে ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় ৩৪টি গুরুতর অপরাধে মি. ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট দলের মনোনয়ন জেতার দৌড়ের বিষয়ে তিনি মনোনিবেশ করেন ২০০০ সালে প্রথমে রিফর্ম পার্টির হয়ে এবং ২০১২ সালে রিপাবলিকান হিসেবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ‘বার্থরিজম’-এর সবচেয়ে সোচ্চার প্রবক্তাদের মধ্যে একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৫ সালের জুনের আগ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউসের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ঘোষণা করেননি।
নির্বাচনী প্রচারে তার সম্পদ এবং ব্যবসায়িক সাফল্যকে জাহির করতে দেখা গিয়েছিল এ রিয়েল এস্টেট টাইকুনকে। তিনি মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে ‘মাদক, অপরাধ ও ধর্ষকদের পাঠানোর’ অভিযোগ আনেন এবং দাবি করেন সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের খরচ ওই দেশকেই দিতে হবে।
বিতর্ক অনুষ্ঠানের মঞ্চে এ ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য এবং মঞ্চে আধিপত্য বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব তার সমর্থক এবং তীব্র সমালোচকদের সমান পরিমাণে আকর্ষণ করেছিল। গণমাধ্যমেও বারবার শিরোনামে উঠে আসে তার বিভিন্ন মন্তব্য।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’-কে তার প্রচারাভিযানের স্লোগান বানিয়ে সহজেই রিপাবলিকান পার্টির অন্য সদস্যদের পেছনে ফেলে দিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের মুখোমুখি হন। তার এই প্রচারাভিযান অবশ্য বিতর্কে ঘেরা ছিল। তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে থাকে।
তবে প্রবীণ রাজনীতিবিদদের ও জরিপকারীদের স্তব্ধ করে দিয়ে জয়ের শেষ হাসি হেসেছিলেন ট্রাম্প। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ঘণ্টা থেকেই তার কার্যকালে বারেবারে নাটকীয়তা দেখা যায়।
ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প প্রধান জলবায়ু ও বাণিজ্য চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন, সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দেন, অভিবাসন সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করে দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যাকে অভিশংসিত হতে হয়েছিল। ডেমোক্রেট নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি পরিষদে তাকে অভিশংসিত করা হলেও রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন সিনেটে তিনি খালাস পান।
২০২০ সালেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদের জন্য রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ভোটে নামেন। সেই বছর করোনাভাইরাস মহামারির আধিক্য দেখা যায়। ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে।
নানা নাটকীয়তা শেষে ৭ কোটি ৪০ লাখ ভোট পেয়েও জো বাইডেনের কাছে ৭০ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। তা মেনে নিতে পারেননি তিনি। বাইডেনের বিরুদ্ধে ভোট চুরি এবং ব্যাপক নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে আদালতের শরণাপন্নও হয়েছিলেন।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের নিয়ে সমাবেশ করেন এবং তাদের ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাপিটলে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান কারণ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জয়ী ঘোষণা করার কথা ছিল।
সেই সমাবেশ দাঙ্গায় রূপ নেয়। এ ঘটনা তার আইনপ্রণেতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিপদে ফেলে দেয়। এ ঘটনার ফলে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত হতে হয় ট্রাম্পকে। যদিও এবারও তাকে বেকসুর খালাস করে দেয় সিনেট।
ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছে বলেই অনুমান করা হয়েছিল। দাতা ও সমর্থকেরা আর কখনও তাকে সমর্থন করবেন না বলে শপথ করেন। এমনকি নিকটতম মিত্ররাও প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে অস্বীকার করেন।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এড়িয়ে যান তিনি। নিজের পরিবারকে ফ্লোরিডায় স্থানান্তরিত করে দেন। তবে তার অনুগত ভক্তদের একটি অংশ এখনও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে। একইসঙ্গে রিপাবলিকান পার্টিতেও তার ব্যাপক প্রভাব বজায় রয়েছে।
গত ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ায় এক নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পরে স্নাইপারের গুলিতে ওই হামলাকারীর মৃত্যু হয়।
এর কদিন পর ‘রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে’ তার পার্টি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে টানা তৃতীয়বারের মতো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ঘোষণাও করা হয়।
পেনসিলভানিয়ার নির্বাচনি প্রচারাভিযানে হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে ফ্লোরিডায় তাকে আবারও হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
ডেমোক্রেট আমলে যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত লাভ দেখা গেলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অবৈধ অভিবাসন ও পররাষ্ট্রনীতির বিশৃঙ্খলাসহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ওই পদের জন্য মনোনীত করেন। এ সময় থেকেই ট্রাম্প হ্যারিসকে প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করার চেষ্টা করে আসছেন। তার এ প্রয়াস ‘মাঝারি সাফল্য’ পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জরিপগুলোর ইঙ্গিত, হ্যারিস উদারপন্থী ভোটারদের উদ্দীপ্ত করার পাশাপাশি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেও নির্বাচনী দৌড়ে স্থিতাবস্থায় রয়েছেন।
অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন, ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর ‘আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন’ হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০২৪
আরএইচ