চীনের নতুন এ প্রযুক্তি এককভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একে শুধু টেলিকম প্রযুক্তির সরঞ্জাম এবং চীন-ভারত বাণিজ্যের অংশ ভাবার কোনো উপায় নেই।
বিশ্বের উৎপাদনকারীরা যাকে এখন ‘ইন চায়না ফর চায়না’ মনে করছে, তা দ্রুতই ‘বাই চায়না ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ হয়ে উঠবে। চার স্তরের একটি কেক কল্পনা করুন- যার নিচের স্তরে বিআরআই, ওপরের স্তরে চাইনিজ স্ট্যান্ডার্ডস-২০৩৫ এবং মাঝের স্তরে ডিজিটাল সিল্করুট প্রকল্প ও মেইড ইন চায়না-২০২৫। ৫জি হচ্ছে অনেকটা এই কেকের স্ট্যান্ডের মতো, যার সাহায্যে চীনের চারটি প্রকল্প সম্ভব হওয়ার পথ তৈরি হবে।
বিশ্বজুড়ে যতগুলো ৫জি নেটওয়ার্ক বিক্রি করবে চীন, এর প্রতিটিই এ কেক-স্ট্যান্ডে অতিরিক্ত একটি পা যুক্ত করবে এবং এর ফলে চার স্তরের কেকটি আরও সহায়তা এবং শক্তি পাবে। অন্যদিকে, স্ট্যান্ডটি কোনো সহায়তা দিতে না পারলে, চার স্তরের কেকটি মাটিতে পড়ে যাবে। তখন এর প্রতিক্রিয়া হবে দ্বিগুণ। বিশ্বজুড়ে চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য ও ক্ষমতা কমবে। দ্বিতীয়ত, উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারলে সাধারণ চীনা নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষও সৃষ্টি হতে পারে।
চীনে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মজুরিও বেড়েছে। চীন দীর্ঘদিন ধরে ‘বিশ্বের ফ্যাক্টরি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যে সাফল্যের সূর্য এখন অস্তগামী। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১ শতাংশ, যা কয়েক দশকে সর্বনিম্ন।
স্বৈরাচারী শাসন থেকে চীনা জনগণের প্রধান চাওয়া উন্নত জীবন ব্যবস্থা। এ সামাজিক চুক্তি এখনো লঙ্ঘন না হলেও ঝুঁকিতে রয়েছে। গত মাসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রিমিয়ার লি কেকিয়াং বলেছেন, ‘চীনে ৬শ’ মিলিয়ন দরিদ্র বাস করেন, যাদের মাসিক আয় ১৬১ ডলার এবং এ দারিদ্র্য থেকে তাদের বের করতে হবে। ’
ওপরে বর্ণিত কেক-স্ট্যান্ডের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভটি ইতোমধ্যে দুর্বল হয়ে গেছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান ৫জি নেটওয়ার্কের সরঞ্জামের জন্য চীন বাদে অন্য দেশি সরবরাহকারী খুঁজছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের কিছু দেশ ঘোষণা দিয়েছে, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকায় চীনা সরঞ্জাম বিক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি তারা পুনর্মূল্যায়ন করছে। ভিয়েতনাম নিজেরাই ৫জি প্রযুক্তি ডেভেলপ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র চাইনিজ ৫জি প্রযুক্তি বয়কট করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ৫জি আলাপ-আলোচনার টেবিলে ভারতকে ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে চীন। এক্ষেত্রে সীমান্তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংঘাত, ভারতের পশ্চিম উপকূলের তেল শোধনাগারে ড্রোন হামলা, সাইবার হামলাসহ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে পারে চীন।
বর্তমান ৪জি প্রযুক্তির আপগ্রেড এবং ভবিষ্যতের ৫জি চুক্তি প্রত্যাহার করায় ভারতীয় টেলিকম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে চীন। এতে মোটা অংকের জরিমানা দিতে হলে, এর অর্থ বরাদ্দ করতে হবে সরকারকেই।
অন্যদিকে চীন বাদে অন্য দেশি কোম্পানিগুলোর পণ্য আরও ব্যয়বহুল হওয়ায় ইতোমধ্যে বিপর্যস্ত ভারতীয় টেলিকম খাতকে আরও দৃঢ় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে এবং কর কমিয়ে এ খাতকে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে বর্তমান হার্ডওয়্যার নির্ভর নেটওয়ার্ক একসময় সফটওয়্যার নির্ভর হয়ে উঠবে।
হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেই ৫জি সরঞ্জাম কিনতে হবে ভারতকে। এতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য (এফটিএ) সুবিধা কাজে লাগাতে পারে ভারত। যুক্তরাজ্য প্রস্তাবিত ডি১০ ক্লাবের অংশও হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে ভারতকে। এতে জি৭ এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও থাকবে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। এ ১০টি দেশের টেলিকম কোম্পানিতে বিনিয়োগের চ্যানেল তৈরির জন্য এ সংস্থাটি গঠন করা হবে। ৫জি সরঞ্জাম এবং অন্য প্রযুক্তি সরবরাহের জন্য চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে কাজ করবে এ সংস্থাটি।
শেষ পর্যন্ত চীনে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের সূত্রপাত ঘটাতে কি অবদান রাখবে ভারত? বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যা করতে পারেনি, জি২০ দেশগুলো চীনা ৫জি সরঞ্জাম বয়কট করলে এবং ৬শ’ মিলিয়ন বঞ্চিত চীনা রাস্তায় নামলে হয়তো তা সম্ভব হতেও পারে।
লেখক: ব্লেইস ফার্নান্দেজ। পরিচালক, গেটওয়ে হাউস
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২০
এফএম