ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাঙ্কারে যৌন হয়রানির মুখে নারীরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০২০
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বাঙ্কারে যৌন হয়রানির মুখে নারীরা

কাশ্মীরের নিলাম ভ্যালি; যেখানে আরেকটি লকডাউন চলছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নয়, ধেয়ে আসা আর্টিলারি শেলের আঘাত থেকে জীবন বাঁচাতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সেখানকার অধিবাসীদের।

তবে নিলাম ভ্যালির নারীদের দশা সবচেয়ে বেশি শোচনীয়। বোমার আঘাত অথবা যৌন নির্যাতন— এই দুই ঝুঁকির যে কোনো একটি বেছে নিতে হচ্ছে তাদের।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কাশ্মীরে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে গোলাগুলি তীব্র আকার ধারণ করেছে। সীমান্তে গোলাগুলির উপক্রম হলে সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন কমিউনিটি বাঙ্কারে চলে যাচ্ছেন, বিশেষ করে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে।

কিন্তু জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেওয়া সেইসব বাঙ্কার যৌন নিপীড়কদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই কিছু পরিবার গোলাগুলির সময় তাদের পরিবারের কন্যা ও অল্প বয়সী নারীদের বাড়িতেই ঝুঁকির মধ্যেই রাখছে, যাতে বাঙ্কারে গিয়ে তাদের যৌন নির্যাতনের মহামারির মুখে না পড়তে হয়।

মর্টার বর্ষণের সময়েও বাড়িতে রয়ে যাওয়া তেমন একজন হলেন ২৫ বছর বয়সী মেহনাজ। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে কখনোই বাঙ্কারে যাবেন না তিনি।

গত আগস্টে কাশ্মীরের পাকিস্তান অংশের নীলাম ভ্যালিতে মর্টার বর্ষণ শুরু হলে মেহনাজ ও তার পরিবার প্রতিবেশীর মালিকানাধীন একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। গোলাগুলি না থামা পর্যন্ত কয়েক ডজন লোক কয়েক ঘণ্টা সেই বাঙ্কারে আটকে থাকে।

সেই ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেই ‘একজন আমাকে স্পর্শ করতে শুরু করে’—নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন মেহনাজ। যৌন নিপীড়নের ভুক্তভোগীর ‘কলঙ্ক’ এড়াতে সাক্ষাৎকারে নিজের নামের একাংশ উল্লেখ করেন তিনি।

মেহনাজ বলেন, পুরুষদের মধ্যে একজন আমাকে স্পর্শ করতে শুরু করে। বাঙ্কারের অন্ধকারে বাবা-মা সবাই গোলাগুলি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় কেউ মনোযোগ দিচ্ছিল না।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই পুরুষের ভয়ঙ্কর হাত থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন মেহনাজ। কয়েক ঘণ্টা পর গোলাগুলি থেমে গেলে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর মেহনাজ তার মাকে জানান বাঙ্কারের ঘটনা জানান।  

ঘটনা শুনে নিরুপায় মেহনাজের মা জানান, তিনি কিছুই করতে পারবেন না। কারণ নিপীড়নকারী ওই ব্যক্তিই বাঙ্কারের মালিক। মেহনাজের মায়ের আশঙ্কা, অভিযোগ করলে বাঙ্কারের সুরক্ষা হারাতে হবে তার পরিবারকে।

এরপর থেকে গোলাগুলি চলাকালে মেহনাজ তার বোন ও ভাবীর সঙ্গে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতেই থেকে যান।

পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরজুড়ে গ্রাম ও শহরগুলিতে স্বচ্ছল পরিবারগুলি নিজেদের বাঙ্কার নিজেরাই তৈরি করে। আর মেহনাজের মতো দরিদ্র পরিবারগুলি তাদের প্রতিবেশীদের বাঙ্কারের ওপর নির্ভরশীল, বিনিময়ে আশ্রয়কেন্দ্রের মালিকের সহজ যৌন শিকারে পরিণত হন তারা। তাদের অভিভাবকরাও বোমার আঘাত থেকে জীবন বাঁচাতে যৌন নিপীড়ন প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থাকেন।

সাধারণত পাকিস্তানে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো অজানাই রয়ে যায়। কারণ, ভুক্তভোগী মেয়ের পিতামাতা পরিবারের সম্মান রক্ষায় মেয়েকে ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দিতে চান। কখনো কখনো ভিকটিমকে হত্যাও করা হয়।

পাকিস্তানের সীমান্তে বাঙ্কারগুলিতে যৌন সহিংসতার সমস্যাটি কতটা বিস্তৃত তা অনুমান করা অসম্ভব, তবে প্রায় দুই ডজনেরও বেশি নারী-পুরুষের সাক্ষাত্কারে বিষয়টি প্রচলিত বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।

কাশ্মীরি গবেষক ও পণ্ডিত আমিনা মীর বলেন, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাঙ্কারগুলিতে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা। তবে স্থানীয় সম্প্রদায় বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না। নারীরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তাও পায় না।

৭৩ বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আছে কাশ্মীর। ভারত সরকার তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকে সীমান্তে ভয়াবহ গোলাবর্ষণ প্রত্যক্ষ করছেন এর অধিবাসীরা।

ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ নামে পাকিস্তানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, জানুয়ারির পর থেকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ৪৫টি হামলায় নয় জন মারা গেছেন এবং ৬০ জন আহত হয়েছেন।

পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর নামে পরিচিত পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নাগরিকদের জন্য আরও বেশকিছু বাঙ্কার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

পাকিস্তানের স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত গ্রীষ্মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙ্কার তৈরির জন্য প্রথম তহবিল সরবরাহ করা হয় এবং এখন পর্যন্ত ৭০টি বাঙ্কার নির্মিত হয়েছে। যা বড় একটি বালতিতে একটি মাত্র ফোঁটার সমতুল্য! স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, ১ লাখ ১০ হাজার পরিবার আগুনের গোলার সামনে দাঁড়িয়ে, তাদের আশ্রয় প্রয়োজন।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল নীলাম ভ্যালিতে বাঙ্কার তৈরি করতে আজাদ জম্মু ও কাশ্মীরের সরকারকে এক লাখ ২০ হাজার ডলার সরবরাহ করা হয়েছে। তবে অন্যান্য অরক্ষিত অঞ্চলগুলিতে এখনও এক ডলারও বরাদ্দ করা হয়নি।

আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের মুখ্য সচিব সৈয়দ আসিফ হুসেন বলেন, আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী বাঙ্কার তৈরিতে প্রয়োজন ৩৪ মিলিয়ন ডলার।

১৯৯৮ সালে সীমান্তবর্তী শহর আথমুকামে ছেলেমেয়েদের নিয়ে একা ছিলেন নাসরিন। তার ট্রাকচালক স্বামী তখন রাস্তায়। যখন মর্টার বর্ষণ শুরু হলো নিজের পাঁচ সন্তানকে জড়ো করে পাশের বাঙ্কারে আশ্রয় নিলেন নাসরিন। প্রতিবেশী আরও পাঁচ পরিবারের সদস্যরাও ৩২ বর্গফুট আকৃতির ওই বাঙ্কারে ল্যাপ্টালেপ্টি করে দমবন্ধ অবস্থায় পড়েছিল।

নাসরিন এখনও ওই শহরের বাসিন্দা। তবে মর্টার বৃষ্টির সময় বাঙ্কারে আর ছুটে যান না তিনি।

‘পুরো একদিন ও রাত বাঙ্কারের অন্ধকারে কাটিয়েছিলাম’। নাসরিন জানান, সেদিন তার ১৩ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সী এক ব্যক্তির দ্বারা।

বাঙ্কার থেকে ফিরে আয়েশা তার মাকে বলে, লোকটি তাকে স্পর্শ করছিল। কিন্তু ভয় ও লজ্জায় আয়েশা সেদিন ধর্ষিত হওয়ার কথা মায়ের কাছেও বলেনি।

সেদিনের পরও সন্তানদের নিয়ে আরও বহুবার বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়েছে নাসরিনকে, মেয়ে আয়েশার আপত্তি সত্ত্বেও। মেয়ে তার নির্যাতনকারীকে দেখতে পাবে জেনেও তিনি তার সব সন্তানকে বাঙ্কারে নামতে বাধ্য করেছিলেন।

নাসরিন বলেন, প্রতিবার মর্টার হামলা শুরু হওয়ার পর বাচ্চাদের বাঁচাতে বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আমার ছিল না। আশ্রয় নেওয়ার জন্য ধারে কাছে আর কোন বাঙ্কারও ছিল না। আমি শুধু আয়েশাকে ওই লোকের কাছ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেছি।

কয়েক মাস পরে নাসরিন তার মেয়েকে বমি ও জ্বরে ভুগতে দেখে হাসপাতালে নিতে চাইলে আয়েশা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ডাক্তার নাসরিনকে জানায় আয়েশা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শেষে আয়েশা তার মাকে বলে যে, লোকটি তাকে বাঙ্কারে নিচে ফেলে ধর্ষণ করেছিল।

আয়েশা তার মাকে আরও জানায়, ওই ব্যক্তি তাকে ছুরি ঠেকিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছিল, সে যদি তাকে সহযোগিতা না করে এবং ধর্ষণের বিষয়ে কাউকে কিছু জানায় তাহলে সে তাকে খুন করবে। সেদিনের পরে আরও বহুবার ওই লোক তাকে ধর্ষণ করেছে বলে মায়ের কাছে স্বীকার করে আয়েশা।

এ ঘটনায় আয়েশার পরিবার বিচার চাইলে তাদের সম্প্রদায় ধর্ষণকারীর সঙ্গে আয়েশাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েক মাস পরে বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে অধিক রক্তক্ষরণে আয়েশার মৃত্যু হয়। অকালে জন্মগ্রহণকারী তার ছেলেটিও কয়েক মাস পরে মারা যায়।

নাসরিন বলেন, আমাদের যদি তখন নিজের বাঙ্কার থাকতো তবে আমার মেয়েকে ধর্ষিত হতে হতো না, সে মারাও যেত না।

তিনি আরও বলেন, আমি কখনই আর আমার বাচ্চাদের এমন কোন বাঙ্কারে নিয়ে যাব না যেখানে তাদের জীবন বা সম্মান হুমকির মুখে পড়বে।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০২০
এমজেএফ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।