যিশু খ্রিস্টের জন্মের তিন-চার হাজার বছর আগের কথা। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ এর আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে বাস করত বেশ কয়েকটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ।
এ গোষ্ঠী সমূহের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ ও পশু শিকার। তারা কথা বলতো তাদের নিজস্ব ভাষায়। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত ছিল দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা, উত্তর ও মধ্য ভারতে ছিল অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা। আবার হিমালয় পর্বতের নিকটবর্তী অঞ্চল এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ চীন-মায়ানমার এবং ভারতের আসামের সীমান্তবর্তী এলাকায় যারা বাস করত, তাদের ভাষায় ছিল অন্য একটি ভাষার প্রভাব। এর নাম ভোট-চীনীয় ভাষা।
তবে এদের কারো ভাষারই শব্দ ভাণ্ডার বা সাহিত্যের দিক থেকে শক্তিশালী ছিল না। আবার তাদের ভাষা ছিল কেবলই মৌখিক। লেখালেখির জন্য তাদের কোনো লিপিও ছিল না। তোমাদের এখন যে সময়ের কথা বলছি।
ঠিক একই সময়ে পৃথিবীর অন্য একটি অঞ্চলে কী ঘটছে দেখে আসি।
আমরা এখন যে দেশকে ইরান নামে জানি, তার আগের নাম ছিল পারস্য। এই পারস্য ও বর্তমান ইরাক অঞ্চলে বাস করতো একটি জাতি। এদের মুখের ভাষার নাম ছিল আর্য। আর এই ভাষার নাম অনুসারেই পৃথিবীতে তারা আর্য নামে পরিচিত ছিল।
এদের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় নামক একটি উন্নত ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এদের ভাষা ও সাহিত্য ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। আবার, লেখার জন্য নিজস্ব লিপিও ছিল। এবার বলছি এই আর্যদের কথা।
আর্যরা ছিল যাযাবর। অর্থাৎ, তারা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে বাস করত না। দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াতো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। তারা পশুপালন করত। আবার, ঘোড়াকে বশ মানিয়ে টগবগিয়ে ছুটেও বেড়াতো। বিভিন্ন কাজে তাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা সমস্যায় পড়তে লাগলো তারা। দিনদিন জনসংখ্যা বাড়তে লাগলো, খাদ্য ও শিকারের অভাব দেখা দিলো।
একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নাস্তানাবুদ হতে লাগলো, অন্যদিকে আধিপত্য নিয়ে নিজেদের মধ্যে দেখা দিল ঝগড়াঝাটি। এরকম পরিস্থিতে তারা আর একসঙ্গে থাকতে পারলো না। ছোটো ছোটো দলে ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে।
এভাবেই আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে এবং পঞ্চনদীর দেশ বলে খ্যাত পাঞ্জাবে প্রথম প্রবেশ করে আর্যরা। এভাবে তারা ধীরে ধীরে মগধ, রাঢ়, বরেন্দ্র, কামরূপসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
আর্যরা এখানে আসার পরে তারা আর তাদের ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে পারেনি। কারণ, নিভৃতে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা গেলেও দৈনন্দিন কাজে তাদের স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মিশতে হতো। ফলে স্থানীয় মানুষদের ভাষার উপাদান, যেমন- শব্দ, ধ্বনিরূপ প্রভৃতি তাদের ভাষায় প্রবেশ করে। আবার আর্যরা শিল্প-সাহিত্য, যুদ্ধকৌশলসহ বিভিন্ন কাজে দক্ষ ও প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় মানুষরাও তাদের সঙ্গে চলাফেরা করতে শুরু করে।
এ দুয়ের মিশ্রণে এখানে নতুন একটি ভাষারূপের জন্ম হয়।
এরকম অবস্থায় আর্যদের দ্বিতীয় দলটি ভারতে প্রবেশ করে। দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। ফলে এক দল ভারতের কেন্দ্রীয় এলাকা ছেড়ে দূরবর্তী অঞ্চলে সরে আসে। এভাবে অঞ্চলভেদে তৈরি হয় নতুন নতুন ভাষারূপ। একটি ভাষার সঙ্গে অন্য আরেকটি ভাষার পার্থক্য বাড়তে থাকে। এভাবেই জন্ম নেয় বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষা।
আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম যে ভাষা ব্যবহার করেছিল তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। এর অপর নাম বৈদিক ভাষা বা প্রাচীন আর্য ভাষা। কিন্তু ভাষার মূল ধর্মই হলো পরিবর্তন হওয়া। এই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাও মানুষের মুখে মুখে ব্যবহৃত হতে হতে বিকৃত হতে লাগলো।
এ পরিবর্তন স্বাভাবিক হলেও পণ্ডিতরা তখন তা মেনে নিতে পারেন নি। তারা এর সংস্কার করলেন এবং ভাষা ব্যবহারের কতগুলো নিয়ম করে দিলেন। ফলে এ ভাষার নাম হয়ে যায় সংস্কৃত ভাষা। এ সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দ আমাদের বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
যাইহোক, বন্ধুরা, নিয়মকানুনের কড়াকড়ি থাকায় সংস্কৃত ভাষা আর সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থাকলো না। তা হয়ে গেলো কেবলই সাহিত্য রচনার ভাষা। অন্যদিকে, মানুষের মুখে মুখে চলতে লাগলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার অন্য একটি রূপ। এর নাম প্রাকৃত ভাষা। প্রাকৃত ভাষাও সুবোধ বালিকাটি হয়ে থাকেনি। তিড়িংবিড়িং করে চলতে চলতে তৈরি করেছে নতুন একটি ভাষারূপ। এর নাম অপভ্রংশ। এটি প্রাকৃত ভাষার সর্বশেষ স্তর। আর এ স্তর থেকেই জন্ম নিয়েছে বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষা।
আইরিশ অর্থাৎ আয়ারল্যান্ডের ভাষাবিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন প্রথম জানান যে মাগধি প্রাকৃত থেকে সৃষ্টি হওয়া মাগধী অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার আরেকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এ মত সমর্থন করেছেন। তবে বাংলাদেশের আরেকজন বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, মাগধী অপভ্রংশ নয়, গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে সৃষ্টি হওয়া গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম।
এবার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মত অনুসরে এক নজরে দেখি বাংলা ভাষার জন্মের বিভিন্ন স্তরের সময়কাল:
ক. ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা (অনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
খ. শতম (৩৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
গ. আর্য ভাষা (২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
ঘ. ভারতীয় (১৫০০-১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
ঙ. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
চ. প্রাচী প্রাকৃত (৮০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
ছ. সংস্কৃত (৬০০-)
জ. প্রাচীন প্রাচ্য (৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)
ঝ. গৌড়ীয় প্রাকৃত (২০০ খ্রিস্টাব্দ)
ঞ. গৌড়ীয় অপভ্রংশ (৪০০- ৬০০ খ্রিস্টাব্দ)
ট. বঙ্গকামরূপী (৫০০ খ্রিস্টাব্দ)
ঠ. বাংলা (৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)
বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইচ্ছেঘুড়ি
ichchheghuri@banglanews24.com